ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছাত্র আন্দোলনে নতুন মোড়

ছাত্র আন্দোলনে নতুন মোড়

পৃথিবীতে যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, সাধারণ মানুষ। আজ দুনিয়ার পরিবর্তন-পরিচ্ছন্নতা, প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি গড়ে উঠেছে বুদ্ধি-চিন্তা-প্রতিবাদ-আন্দোলনের মাধ্যমে। ঝর্ণাস্রোত ক্রমেই যে সাগর সৃষ্টি করে বসুন্ধরার নব-উত্থানও তেমনি। হয়তো দুই একজন আমলাবাদে সিংহভাগ নেতা প্রতিবাদ-আন্দোলনের ফলেই গড়ে উঠেছে। অবশ্য অনেক আমলা ছাত্রজীবনে আন্দোলনে সদাপ্রাণ ছিলেন। এর ব্যতিক্রমও কিছু আছে যারা সবর্দা নিজের স্বার্থচিন্তায় ছিলেন ডুবে।

এসব আন্দোলনের ধারারও আছে নানা দিক, নানান পরিবর্তন। নানান রকম পদ্ধতি। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে হতে হয় বিনম্র তবে তেজী ও সাহসী। কখনো নির্যাতিত হতে হতে মানুষ আগ্রাসী হয়ে উঠে প্রবল সাইক্লোনের মতো।

আন্দোলনে সাধারণত অধিকারহারা, বঞ্চিত, নির্যাতিত, হক্বদার ও বিবেকবান মানুষরাই এগিয়ে আসে, থাকে, কাজ করে। সমস্যার সমাধানে অনবরত প্রচেষ্টা চালায়। কখনো সফল আবার বিপরীত চিত্রও থাকে। ব্যর্থ হলেও একথা বলার কোন অবকাশ নেই যে সে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অযোগ্য। তারচেয়ে সত্য ও সঠিক কথা হচ্ছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীটি তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছে। তাতে এই ব্যক্তিরা প্রত্যাশিত ফল না পেলেও আগামীতে কেউ হয়তো সেইপথে মানুষের আকাক্সক্ষা পূরণে এগিয়ে আসবে, সক্ষম হবে। মূলত শুরুতো হলো বীজবপণ।

আবার যার বা যাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-আন্দোলন হচ্ছে তাদের সবকিছুই মন্দ বা খারাপ, অসৎ ও কদর্য নয় বরং দুই একটি বিষয় এই পর্যায়ভুক্ত। তাদের কিছু কাজের/কথা/সিদ্ধান্তের কারণে যে প্রতিবাদ বা আন্দোলন হলো তার অর্থ এই নয় যে, এসব ব্যক্তিবর্গ পরস্পর শত্রু। বরং এসব অন্যায় ও অন্যায্যপথ থেকে তাদেরকে ফেরাতে যে প্রতিবাদ ও আন্দোলন হলো এই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলোই তাদের আপনজন। কেননা তাদেরকে অন্যায় ও অন্যায্যপথ থেকে এরাই ফিরিয়ে এনেছে। তাদের কল্যাণ করেছে। এই সৎকাজের ফলে উভয়েই প্রকৃত বন্ধুত্বের বৃক্ষরোপন করলেন। এই বৃক্ষের ছায়া, ফুল, ফল, বাতাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পারস্পারিক সম্মান ও কল্যাণের আলোকবার্তা বয়ে চলবে। দিকনির্দেশনা দেবে।

এমনই একটি কল্যাণ ও দিগন্ত উন্মোচন করা প্রতিবাদ ও আন্দোলন ছিল ২০১৫ সালের বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ওপর আরোপিত প্রথমে ১০ ও চূড়ান্তভাবে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট। এটি মানুষের মৌলিক অধিকারে আঘাতহানা ও অস্তিত্বকে নষ্ট করার হাতিয়ার। অপরদিকে আরোপকারী ব্যক্তিবর্গের নৈতিকতা ও দায়বন্ধতার অসৎচিন্তার নি:কৃষ্ট উদাহরণ, যা তাদেরকে সমাজে হেয় ও ঘৃণিত করে তুলে। ব্যক্তিত্ব ও রাষ্ট্রকে নষ্ট ও কলঙ্কিত করে। সুনাম ধ্বংস করে।

পর্যায়ক্রমেই নানাপ্রান্তে ছাত্ররা প্রতিবাদ ও আন্দোলনে ফেঁটেপড়ে। চারদিক থেকে শিক্ষার্থীদের মিলিত করা হয় নো ভ্যাট অন এডুকেশনের ছায়াতলে। সকলের মতামত ও চিন্তাচেতনা, সার্বিক সহযোগিতা ও পরিশ্রমে দ্রুত হতে দ্রুততম সময়ে বাতাসের স্রোতে আলোর গতিতে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছড়িয়েপড়ে নো ভ্যাট অন এডুকেশনের শান্তিপূর্ণ একেক কর্মসূচি। ধারাবাহিক কর্মসূচি চলতে থাকে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এসব কর্মসূচি চলাকালে ৯ সেপ্টেম্বর ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনে পুলিশের লাঠিপেটা ও গুলিবর্ষণে আমাদেরকে আন্দোলনে নিতে হয় ভিন্নপথ। যদিও এর আগে ১৩ আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রায় রাজধানী ঢাকার শাহবাগে আমাদের আন্দোলনকারীদের উপর হামলা, লাঠিপেটা ও রক্তঝরানো হয়। পুলিশের যুদ্ধেংদেহী অবস্থানকে পাত্তা না দিয়ে আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চলে। তবে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ওভারব্রিজের উত্তরে আর যেতে দেয়নি পুলিশপ্রশাসন।

তারপর আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে ভিন্নপন্থায় এগিয়ে যেতে হয় আমাদের। চলে প্রতিটি ক্যাম্পাসে আন্দোলন গড়ে তোলা, আরো সম্প্রসারণ ও মজবুত সংযোগ। প্রতিবাদ, মানববন্ধন, স্মারকলিটি পেশ, কুশপুত্তলিকা দাহ, ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংযোগ ও বন্ধন বৃদ্ধি। পরামর্শের ভিত্তিতে কাজের গতিবেত বৃদ্ধি।
যাইহোক ইস্টওয়েস্টে পুলিশের গুলির কারণে রাস্তা অবরোধের মত কঠিন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। যা কোরবানির ঈদের পর হওয়ার কথা ছিল তা এগিয়ে আনা হয় ১০ সেপ্টেম্বরে। ১০ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ৫দিনের কর্মসূচিতে দেশের সকল ধরনের জনগণের সমর্থন আদায় করে নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলন। সরকারপ্রধান ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে মন্ত্রিপরিষদসভায় সিদ্ধান্ত নেন এই অন্যায় সিদ্ধান্ত তারা প্রত্যাহার করেছেন। শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যাও।

আমরা ন্যায়ের পতাকা হাতে পেয়ে ভ্যাটমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা পেয়ে ক্যাম্পাসে ফিরলাম। রাস্তাঘাট, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে আমরা নতুন একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম। নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষের মিলনমেলা অভূতপূর্ব দিগন্তের পথ উন্মোচন করে। বিশ্বের ইতিহাসে সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন মোড় ঘুরিয়ে দেয় ছাত্র আন্দোলনের। শুধু বাংলাদেশ নয় ভারত, শ্রীলঙ্কা, গ্রিস, ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তে যেসব ছাত্র আন্দোলন হয়েছে তাদের অনেকগুলোই অনুসরণ করেছে ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ আন্দোলনের আদর্শ। আজ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ এখন হতে ৭ বছর আগের ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ছিল ভ্যাটমুক্ত শিক্ষার পথ উন্মোচন।

শুধু বাংলাদেশ নয় বরং বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা আজ আরো কঠিনতর সমস্যায় পড়ছে। বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় সৃষ্টি হচ্ছে জঞ্জাল। এ থেকে উত্তরণ ও সমৃদ্ধকরণে মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস নামে নো ভ্যাট অন এডুকেশনের জনবল নিয়ে পথ চলছে ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে। আন্দোলনটির মূল দিকদর্শন হচ্ছে-জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্বের সকল দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষা সিলেবাসের ৫০ শতাংশ ও দেশিয়গুলোর মধ্যে ৭০ শতাংশ একই সিলেবাস হওয়া, উচ্চ মাধ্যমিকে ৩০ শতাংশ, মাধ্যমিকে ২৫ শতাংশ এবং প্রাথমিক স্তরে ২০ শতাংশ একই পাঠ্যক্রম থাকা। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্যে বাজেট বৃদ্ধি, শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের চাকরিতে প্রবেশে সঠিক মূল্যায়নসহ শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে সরকারগুলোর আরো উদার দৃষ্টিভঙ্গি আনায়নে প্রচেষ্টা চালানো এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারি নয় বরং রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকিকরণ করা। প্রকৃত কথা হলো-এসব সমস্যার সমাধান রাষ্ট্রকে করতেই হবে।

আজ ১৪ সেপ্টেম্বর নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলনের প্রতিটি ব্যক্তির প্রতি পরম শ্রদ্ধা, সুস্থতা ও সাফল্যজনক জীবনের প্রত্যাশা করছি। সরকারকেও তাদের কল্যাণজনক সিদ্ধান্তের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

লেখক: মুখপাত্র (প্রধান সমন্বয়ক),
নো ভ্যাট অন এডুকেশন।
novatoneducation15@gmail.com

সংবাদটি শেয়ার করুন