ঢাকা | সোমবার
৩০শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৫ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধর্মের কঠোরতা নয় উদারতা

আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক কিংবা মৌলবাদী ধ্যান ধারণার গভীরে অনুসন্ধান চালালে পাশ্চাত্যের দিকেই অভিযোগের তীর ধাবিত হবে। তবে সেক্ষেত্রে নিজেদের দায় দায়িত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করার উপায় নেই। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার জন্য সাম্রাজ্য বাদী শক্তির পাশাপাশি সে সময়ের উচ্চবিত্তরা দায়ী ছিল বহুলাংশে। সেদিনের হিন্দু উচ্চবিত্তদের লাগানো আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন মুসলিম উচ্চবিত্তরা নিজেদের স্বার্থ আর আধিপত্য কায়েমের জন্য। বাউল বা লোকায়ত ধারায় প্রেম ভালোবাসার মাধ্যমে পলকে আপন করার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।

বাউল সাধক ও বাউল গীতিকবিদের সাথে সমাজের নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের একধরনের সহমর্মিতা সব সময়ই লক্ষ্য করা যায়। তারা অতি সহজেই সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের অংশীদার হয়ে উঠেন। তারা অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারনা নিয়ে চলতে পছন্দ করেন। বাংলার মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে যেমন বিভিন্ন ধর্মমত গ্রহণ করেছেন, আবার সময়ের খাতিরে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ধর্মের কঠোরতাকে গ্রহণ না করে গ্রহণ করেছেন উদারতাকে। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের এ অঞ্চলে বিকাশ লাভ করেছে বাউল সাধনা। মাটি ও মানুষের জীবন একাত্ম হয়ে গেছে বাউলের ডেরায়। সাম্যবাদ আর অসাম্প্রদায়িকতার কথা অনেক আগেই বলে গেছেন বাউলগন। লালন শাহ বলেছেন-
‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে……।
বাউল একটি জীবন দর্শন। এখানে সাধনা হয়। এখানে চর্চা হয় মানবতার গান, মানুষের গান, অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান। অন্যান্য বাউলদের থেকে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমও ব্যতিক্রম নন। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম মানুষের জীবনের সুখ দুঃখ প্রেম ভালোবাসার পাশাপাশি গেয়েছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান। দুখী মানুষের মনের কথা বলেছেন অন্তর দিয়ে। তার লেখা ও গাওয়া গানে এবং কর্মে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বারবার। আজীবন তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন। দেড় হাজারেরও বেশি গানের গীতিকার বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম তার গানে তুলে ধরেছেন শোষণ বঞ্চনার কথা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারনা।

আজ থেকে একশো বছর আগেও হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলগুলো ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য আবাস। এধরনের মনন ও চিন্তার নিদর্শন পাওয়া যায় বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের লেখা ও গাওয়া গানে-

‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান ঘাটুগান গাইতাম..।

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের কাছে সব মানুষ ছিল সমান, এক মায়ের সন্তান। তাইতো তিনি অবলীলায় বলতে পেরেছেন-
‘এইসব নিয়ে দ্বন্দ্ব কেন
কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান
তুমিও মানুষ আমিও মানুষ
সবাই এক মায়ের সন্তান।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন