শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মাদার তেরেসা--

মানবতার ফেরিওয়ালা

পৃথিবী জুড়ে আজ হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই আছে। মানবতা আজ বিপন্ন। আয়লানের মতো নিষ্পাপ শিশুরা মুখ থুবড়ে পরে থাকে সাগরের তীরে। একদিকে ক্ষুধার্থ মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ, অন্যদিকে দামি গাড়িতে চড়ে যাওয়া সাহেব। পৃথিবীর চিত্রই আজ এরকম। রাস্তায়-ফুটপাতে অসুস্থ, ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ। এইসব অসহায় মানুষের আর্তনাদ শুনেই একজন এগিয়ে এসেছিলেন। একটি সাদাসিধে মুখায়ব, সাদাসিধে পোশাক আর সঙ্গে সাদাসিধে মন এই নিয়ে মাদার তেরেসা। নিঃসংকোচে মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

ইতিহাসে তার ঠাঁই হয়েছে মানুষের মণিকোঠায়। তিনি মাদার তেরেসা। তার সারাটি জীবনে কেবল মানুষের সেবাই করে গেছেন। তার কাছে ছিল না কোনো ভেদাভেদ। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে তার কোলে আশ্রয় দিয়েছেন। তাই তিনি মাদার। মায়ের মতোই আগলে রেখেছিলেন অসহায় মানুষদের। মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অমর হয়ে আছেন।

মাদার তেরেসার জন্ম ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট আজকের মেসিডোনিয়ার স্কোপিয়ে একটি ক্যাথলিক পরিবারে। মৃত্যু ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার মাদার হাউসে। তার বড় হওয়া ছিল একটি ধর্মীয় অনুশাসন, নিয়মশৃঙ্খলা আর নিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। জন্মই যার মানুষের জন্য তাকে কি সংসারে আবদ্ধ রাখা যায়। ১২ বছর বয়সেই তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ধর্মীয় জীবন যাপনে মনস্থির করেন। ১৯৩১ সালের ২৪ মে সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন।

১৯৩৭ সালের ১৪ মে পূর্ব কলকাতায় একটি লোরেটো কনভেন্ট স্কুলে শুরু হয় তার শিক্ষিকা জীবন। পাশাপাশি তিনি হাসপাতালেও কাজ করতেন। মানুষের দুঃখ, দারিদ্র্যের সঙ্গে এখানেই প্রথম সংগ্রাম আরম্ভ করেন। ১৯৪৮ সালে লোরেটো অভ্যাস ত্যাগ করে দরিদ্রের মাঝে মিশনারি কাজ শুরু করেন। তার পোশাক হয় সেই চিরচেনা নীল পারের সাদা সুতি বস্ত্র। তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং দরিদ্র মানুষের সঙ্গে বস্তি এলাকায় কাজ শুরু করেন।

আরও পড়ুনঃ  শেয়ারবাজারে মিশ্র প্রবণতায় চলছে সূচকের লেনদেনে

১৯৫০ সালে মাদার তেরেসা কলকাতায় মিশনারিজ অফ চ্যারিটি নামে একটি সেবাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার কাজের শুরুটা ছিল প্রায় শূন্য অবস্থায়। তবে তিনি দমে যাননি। সেবার ব্রত যার বুকে পেছনে ফেরার সুযোগ তার নেই। কখনো পিছপা হননি। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি দরিদ্র, অসুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা করে গেছেন। তাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, বেঁচে থাকার স্বপ্ন।

প্রথমদিকে অসহায়দের জন্য কাজ করতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়েন। অর্থ জোগাড়ের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে যান। এসময় ধনীদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিতে হতো তাকে। তার প্রতিষ্ঠিত নির্মল হৃদয় আর্ত মানবতার সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এটি ছিল ঠিকানাহীন, আশ্রয়হীন এবং মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের কাছে পৃথিবীর স্বর্গ। মুসলিমদের কুরআন পড়তে দেয়া হয়, হিন্দুদের গঙ্গার জলের সুবিধা দেয়া হয় আর ক্যাথলিকদের প্রদান করা হয় লাস্ট রাইটের সুবিধা। মৃত্যুর আগে এসব অসহায় মানুষ বুঝতে পারতো পৃথিবীটা নিষ্ঠুর নয় অন্তত যতটা তিনি মনে করতেন।

তেরেসা সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস আনতে পারতেন এবং জগতে ভালোবাসার মতো কেউ আছে সেটাও বুঝতে পারতেন। তাদের মৃত্যু হতো সম্মানের। এ বিষয়ে মাদার তেরেসা বলেন, ‘A beautiful death is for people who lived like animals to die like angles-loved and wanted. প্রতিটি মানুষই নিজের শেষ সময়টা একটু ভালোবাসা এবং শান্তি প্রত্যাশা করে। মাদার তেরেসা সেই চেষ্টাই করেছেন। তার মিশনারিস অফ চ্যারিটি দেশ বিদেশের বহু দাতা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়। এর ফলে অনেক অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।

আরও পড়ুনঃ  করোনায় মৃত ব্যক্তির ছেলের ফেসবুকে আবেগময় স্ট্যাটাস

ভারতের সর্বত্র চ্যারিটির অর্থায়ন ও পরিচালনায় প্রচুর দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, এতিমখানা ও আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতেই বাইরেও তিনি এর কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ভেনিজুয়েলা, তানজানিয়া, রোম, অষ্ট্রিয়াসহ ১৯৭০ এর দশকে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েক ডজন দেশে শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে পৃথিবীর ১০০টিরও বেশি দেশে মোট ৫১৭টি মিশন পরিচালনা করছিলেন। মাত্র ১৩ জন সদস্য নিয়ে যে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল সময়ের ব্যবধানে তা কয়েক হাজারে পৌঁছায়।

মাদার তেরেসা প্রথম পুরস্কার পান ১৯৬২ সালে। ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। পরে দুস্থ মানবতার সেবায় আত্নোৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল পুরস্কারের অর্থ এবং তার অন্যান্য পুরস্কারের টাকা তিনি নিজের ভোগ বিলাসে ব্যয় করেননি। সবই দান করেন মানবতার সেবায়। অবশ্য টাকা দিয়েই তিনি কী করবেন? নিজের ভোগ বিলাস তো ত্যাগ করেছেন অনেক আগেই।
এছাড়া ১৯৭১ সালে পোপ জন শান্তি পুরস্কার, ১৯৭২ সালে জওহরলার নেহেরু ও ভারতরত্নসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর যখন পাকিস্থান সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত মেয়েদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। তাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খুললেন। তার প্রতি কেবল বাংলাদেশেরই নয় পুরো মানব জাতির রয়েছে ঋণ। সেই ঋণ শোধ করার মতো নয়। তবে তার দেখানো পথে মানুষকে ভালোবাসলে তার কাজ এগিয়ে নেয়া সম্ভব।

মাদার তেরেসা বলেন, ‘আমার শরীর জুড়ে প্রবাহিত আলবেনিয়ান রক্ত, নাগরিকত্বে একজন ভারতীয় আর ধর্মীয় পরিচয়ে আমি একজন ক্যাথলিক নান। তবে নিজের অন্তর্নিহিত অনুভূতি দিয়ে আমি অবগাহন করি বিশ্বময় এবং মনে প্রাণে আমার অবস্থান যিশুর হৃদয়ে।’ একজন মানুষ কোন ধর্মে জন্ম নিলো, কোন বর্ণে তার জন্ম হলো, কোন গোষ্ঠীতে তার জন্ম হলো আজকের পৃথিবীতে এটাই মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জন্যে কত মানুষকে আশ্রয়হীন হতে হলো, কতজনকে না খেয়ে ঘুমাতে হলো মানবতা থাকলো কি ভুলুণ্ঠিত হলো তাতে কিছু যায় আসে না।

আরও পড়ুনঃ  ডিএসইতে লেনদেন এক বছরে সর্বোচ্চে

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মুক্তগদ্য লেখক, পাবনা

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন