‘তেলের দাম তেলেসমতি, পেঁয়াজে ভীষণ ঝাঁজ,
চালের দাম যেমন তেমন বলতে নেই লাজ’
বাজারে চালসহ সকল পণ্যের দাম বেড়েছে। বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য। লাগামছাড়া দামে শহুরে দারিদ্র্য মানুষের অবস্থা করুণ। গরিব মানুষের সস্তায় ক্রয়ের শেষ পণ্য মোটা চালের কেজি পৌঁছেছে ৫০-৫৫ টাকায়। বেড়েছে তেলের দামের ওপর নির্ভর করছে অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম। পরিণামে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন কৃষক, শ্রমিক এবং পেশাজীবীসহ সীমিত আয়ের মানুষ। অথচ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না। চোখে পড়ছে না সারাদেশে কালোবাজারি ঠেকানোর কার্যক্রম। অনেক ক্ষেত্রে যে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়নি কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সেই পণ্যের দামও বেশি রাখছেন।
প্রতিটি দেশের অর্থনীতির একটি প্রধানতম মাধ্যম থাকে। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। ধান, পাট, গম, চা ও আখ এখনকার কৃষকের আয়ের অন্যতম কৃষিজ ফসল। উর্বর মাটি আর অনুকূল আবহাওয়া এই বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদনের উৎস। বর্তমানে বলা যায়, শতকরা ৭০ ভাগ পরিবার কৃষি আয়ের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া অন্য মানুষ গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করে অনেকটাই বেকারত্ব দূর হয়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি জনজীবন বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। কারণ দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে বেসরকারিখাতে বেতন বাড়ানো হচ্ছে না। আর কৃষি ধানের বাজার মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ অতিরিক্ত।
চা শ্রমিকদের নেই পর্যাপ্ত মজুরি। আন্দোলনের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের মজুরি বৃদ্ধি করেছেন। তাহলে যারা বেসরকারিখাতে আছেন তাদের কী হবে? তাদের বেতন তো বৃদ্ধি করা হচ্ছে না। চাষি তার ফসল বিক্রি করে স্বপ্ন ছিল– ধারদেনা পরিশোধ করার, পরিবার পরিজন নিয়ে তিন বেলা দু’মুঠো খাবার খাওয়ার। কিন্তু যেখানে সংসার চালানোয় দায় সেখানে ধার দেনা কীভাবে পরিশোধ করবে।
বর্তমানে কৃষি কাজ করার জন্য লোক পাওয়া যায় না। তার মানে এইনা যে, সবাই বিলাসী জীবনযাপন করে। ধানের চেয়ে খরচ বেশি হওয়ায় শ্রমিক আগের মূল্যে কাজ করতে চায় না। তারা রিকশা চালায় বা অন্য কাজ করে। সরকার সরাসরি কৃষকের থেকে ফসল সংগ্রহ করে না। তারা ফসল সংগ্রহ করে মধ্যস্থ কারবারি থেকে। ফলে কৃষক হারিয়েছে তার ফসলের লাভ। কৃষকের প্রাপ্য লাভ গিয়ে ওঠে পুঁজিপতির গোলায়।
একদিকে ফসলের লোকসান, করোনার নাকানিচুবানি; আরেকদিকে নিত্যপণ্যের চড়া দামে কৃষকের হাত অর্থশূন্য হওয়ার পথে। প্রথমে বাড়ানো হলো গ্যাসের দাম। আর তারপর তেল থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছুই এখন নাগালের বাইরে। তেলের দাম বাড়লে গাড়ির ভাড়া বাড়বে, সারের দাম বাড়বে, বাড়বে সকল উৎপাদনের খরচ। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম রাতারাতি হু হু করে বাড়তে বাধ্য।
একজন গার্মেন্টস শ্রমিক বেতন পায় ১২-১৪ হাজার তখন ১০-১২ ঘণ্টা ডিউটি করে। অথচ তার রিকশা ভাড়া মাসে ১ হাজার টাকা। গ্যাস, বাড়ি ভাড়া আর এই চড়া দামে বাজার কিনে ধার দেনা করে খাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আর ঢাকা শহরে তো নেই বাড়ি ভাড়ার কোনো নির্দিষ্ট আইন। বাড়ি ভাড়া বাড়াতে থাকে বেতনের মতো। যা বেতন বাড়ে তার ৮০ শতাংশ বাড়ি ভাড়ায় বাড়িয়ে থাকে বাড়িওলারা।
অনেক অফিসে বেতন না পাওয়া বেসরকারি শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাও পার করছেন দুঃসময়। ঠিক এই সময়টাতেই চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাড়লো। চিনি, সয়াবিন তেল, ডাল, শিশুখাদ্য, শাকসবজি, মাছ-মাংস সবকিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। কারণ হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন সরকারি সিদ্ধান্ত এবং বিশ্ববাজারে দামের তালিকা। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে সরকারের ও কিছু করার থাকে না। কারণ বেশির ভাগ জিনিসের উৎপাদন দেশে হয় না।
তবে অন্য দেশের মতো আমাদের দেশে শ্রমের মূল্য দেয়া হয় না। তাই এদেশে গার্মেন্টসশিল্প বেছে নিয়েছে অন্যান্য দেশগুলো। এদেশে শ্রম সস্তা। কেউ পেশা হারিয়ে পূর্বের জমানো সঞ্চয় থেকে জীবন নির্বাহ করছে, আবার কেউ আয়ের সঙ্গে খরচের মিল ধরে রাখতে না পেরে কোনোভাবে দিন কাটাচ্ছে। একদিকে আর্থিক অনটন, অন্যদিকে এ সময়ে যদি দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বাড়তে থাকে, তাহলে তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হবে।
বিগত কয়েক মাসের ব্যবধানে চাল, ডাল ভোজ্যতেল, চিনি ইত্যাদিসহ অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। এর ফলে সমাজের মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণি খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। তাই এ ব্যাপারে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি যাতে কোনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম আরও বাড়িয়ে দিতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
খাদ্যের অভাবে এই পৃথিবীতে কখনও পণ্যের দাম বাড়াতে হয়নি, সংকট লাগেনি। সংকট লেগেছে মজুতদারদের মজুতদারিতে, আড়তদারিতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মহামারি পরবর্তী আমরা দেখেছি, পৃথিবীজুড়ে একদিকে মানুষ না খেয়ে কঙ্কাল হয়ে মরলো, আরেক দিকে মজুতদার কোম্পানি করলো তাদের পণ্য সমুদ্রে নিক্ষেপ। ৪৩ এবং ৭৪-এর সংকটময় পরিস্থিতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এমনকি মজুতদারির কালো প্রভাবের শিকার হয়েছি করোনার আগেই।
লোনা পানির দেশে কৃত্রিম সংকট এবং গুজব ছড়িয়ে লবণকাণ্ড ঘটিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিরিক্ত মুনাফা সৃষ্টির চেষ্টা সবারই মনে থাকার কথা হয়তো। পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে কীভাবে বিপর্যয় নেমে এলো সেটা মজুতদারির জলজ্যান্ত প্রমাণ। পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন এখন বিপর্যস্ত। এর একমাত্র কারণ আয় কমে সবকিছুর দাম বাড়ায় অর্থ কুক্ষিগত হয়েছে পুঁজিপতির ঘরে। অসাধু ব্যবসায়ীরাও অতিরিক্ত মুনাফার লোভ সামলাতে পারছেন না। বিপরীতে বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া লোকজন।
পৃথিবী অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আয় এবং ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করতে না পারলে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার ভারসাম্য সাধারণ মানুষের অধিকার। টিসিবি পণ্যের সহজলভ্যতা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করে বাংলাদেশে দুর্নীতি, কালোবাজারি ও মজুতদারি শক্ত হাতে দমন এখন সময়ের প্রয়োজন। পৃথিবীর নাজুক পরিস্থিতিতে কৃষকদের বাঁচিয়ে কৃষিতে মনোযোগী হলে একদিকে যেমন খাদ্যে জোগান আসবে, ঠিক অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকটজনক সামঞ্জস্যহীনতা মোকাবিলা সম্ভব। নতুবা আমাদের ভাগ্যে অপেক্ষা করছে চরম বিপর্যয়। শুধু দরকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।
লেখক: সাংবাদিক ও ফিচার লেখক
আনন্দবাজার/শহক