প্রতিটি খাতে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই
–বিআইডিএস
বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প-কারখানাগুলোর সমন্বয় করে শিক্ষাব্যবস্থা করতে হবে
–ড. মো. এমদাদ উল্লাহ মিয়া, পরিকল্পনা কমিশনে
দক্ষকর্মীর অভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপদে লোকবল পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভাব পূরণে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। দেশের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো অধিক শিক্ষিত জনশক্ষি পেলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার চিত্র বিপরীত। এ জন্য দেশের প্রতিটি সেক্টরে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (বিআইডিএস) আয়োজিত ‘দ্যা রিসার্চ ফাইন্ডিং অব দ্যা লেবার মার্কেট স্টাডিস ফর সিইআইপি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন এসব কথা বলা হয়। গতকাল রবিবার রাজধানী ঢাকার হোটেল লেকশোরে সকাল ১০টা হতে দুপুর ১টা অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রতিবেদনটির সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-এনএসডিএ এর নির্বাহী চেয়ারম্যান নাসরিন আফরোজ, পরিকল্পনা কমিশনের ইন্ডাস্ট্রি এন্ড এনার্জি ডিভিশনের সদস্য (সচিব) ড. মো. এমদাদ উল্লাহ মিয়া প্রমুখ।
এম এ মান্নান বলেন, গত কয়েক বছরে দেশে অনেক সোনালি ফসল হয়েছে। সরকার ও শিল্প-কারখানাগুলোর মধ্যে আরো সমন্বয় হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও সে পথে হাঁটবে। ২০-২২ বছরে সামরিক ও চাপিয়ে দেয়া শাসনের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা পিছিয়েছিল। এখন সেখানে পরিবর্তন আসছে। এ পর্যন্ত ৬-৮টি কমিশনের রিপোর্ট এসেছে কিন্তু কোনোটিই সঠিক ও পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, মানুষ নিরাপত্তা চায়, নিজের নিরাপত্তা। সেখানে সুবিচার-সুশাসন তারা হয়তো বোঝে না।
গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বোর্ড অব ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমাদের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক বেকার। তাদের প্রবীণদের সেবাদান ও ড্রাইভিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিতে পারি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের পাঠানো সম্ভব। যদিও বিষয়টি সাধারণ দেখা যায়, তবে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশেই তাদের কর্মসংস্থান আছে।
ড. মো. এমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেন, আমরা ব্যবসার ক্ষেত্রে দু’একটি সেক্টরে আবদ্ধ রয়েছে। এটি বাড়ানো দরকার। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প-কারখানাগুলোর সমন্বয় করে শিক্ষাব্যবস্থা করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষিত করা যায় এসব কারখানাকে কাজে লাগিয়ে। ড. মো. এমদাদ উল্লাহ আরও বলেন, এডুকেশনাল কোয়ালিটি ও ট্রেনিং না থাকলে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। কারণ আমাদের উচ্চপদস্থ কাজের জন্য বিদেশিদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হচ্ছে। এতে আমরা লাভবান হচ্ছি না। তাছাড়া করপোরেট কালচার ও গভর্নমেন্টাল কাজে সমন্বয় করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ দিতে হবে।
নাসরিন আফরোজ বলেন, প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বেসরকারি বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসলে তাদের স্বাগত জানানো হবে। তারা নিজেদের প্রয়োজনগুলো উল্লেখ করলে আমরা সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো।
বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চার কাজী ইকবাল গবেষণাটির সারসংক্ষেপ পেশ করেন। প্যানেল আলোচক ছিলেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের পলিসি এডভাইজার আনির চৌধুরী, ওয়াল্টন হাই-টেকের এমডি ও সিইও গোলাম মুরশেদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ইখলাসুর রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা।
কাজী ইকবাল বলেন, আমাগী ১০ বছরে আমাদের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে কেমন শ্রমিক প্রয়োজন তা নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। তাতে ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিদশকে প্রায় এক শতাংশ পয়েন্ট। তবে বাংলাদেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উৎপাদনশীলতার অবদান অনেক কম। মূলত, পুঁজি ও শ্রমের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমেই অর্থনৈতিক প্রবুদ্ধি হয়েছে। এর ঝুঁকি হলো পুঁজি ও শ্রমের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীলতার ফলে প্রবৃদ্ধির হার স্থবির হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন শ্রমের দক্ষতা।
কাজী ইকবাল বলেন, এসব বিষয়কে সামনে রেখে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বিআইডিএস একটি গবেষণা করে। সেখানে ১৪টি গবেষণা প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। তার মধ্যে ১০টি সেক্টরাল প্রতিবেদন, ম্যাক্র ফ্রেমওয়ার্ক, ক্রমবর্ধমান প্রশিক্ষণের চাহিদা সম্বলিত ৫টি অতিরিক্ত সেক্টর সনাক্তকরণ, টিভিইটি এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সম্পর্কে আলোচনা। প্রতিবেদনগুলো তৈরিতে ২৩ জন অর্থনীতিবিদ অংশ নেন। সেক্টরাল স্টাডির জন্য মোট ১১৩৮টি প্রতিষ্ঠান এবং ৭ হাজার ১৮ জন শ্রমিকের ওপর গবেষণা করেছে।
এসবের ফলাফল হলো-
১. দক্ষতার ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ এবং সেক্টরের প্রযুক্তিগত উৎকষতার স্তরের সাথে দক্ষতার ঘাটতি বৃদ্ধি পায়। পেশাদার এবং প্রযুক্তিহত ব্যক্তিদের জন্য দক্ষতার ঘাটতি বেশি। এ জন্য উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পের জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তৈরি পোশাকশিল্পে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি দক্ষ।
২. দক্ষকর্মীর অভাবের কারণে উচ্চতর তথা ম্যানেজার পদে লোক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
৩. নিম্নস্তরের প্রযুক্তিগত উৎকষতাসম্পন্ন শিল্পে কম যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী বেশি। বৃহৎ প্রযুক্তিগতভাবে অত্যাধুনিক শিল্পে অত্যধিক শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী বেশি। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শিক্ষিতকর্মী পাচ্ছে এর বিপরীত চিত্র ছোট ফার্মগুলোতে। সেখানে কম শিক্ষিত কর্মী পাচ্ছে।
৪. সাধারণভাবে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। আর নিয়োগকর্তারাও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন না। তবে এটি নির্মাণখাতে বিপরীত চিত্র।
অনন্দবাজার/শহক