ডলারের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১২১ টাকা ছাড়িয়ে যায় গত ১১ অগাস্ট। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার ছাড়ার পাশাপাশি কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেয়। তবে জুলাইয়ের মাঝামাঝি আবারও আন্তর্জাতিক মুদ্রার বিনিময় হার ১০০ টাকা ছাড়ায়। এরপর আবারও হু হু করে বাড়তে থাকে ডলারের দাম। গেল সপ্তাহে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে প্রতি ডলারের দাম গিয়ে দাঁড়ায় ১২০ টাকা অবধি। ডলারের এমন উল্লম্ফন ঠেকাতে বাজারে নামেন গোয়েন্দারা। গত সপ্তাহ পর্যন্ত ১৩৫টি মানি চেঞ্জারে অভিযান চালিয়ে ৪২টিতে অনিয়ম পাওয়ায় কারণ দর্শানোর (শো’কজ) নোটিস দেওয়া হয়। এছাড়া পাঁচটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চলতি সপ্তাহে গত বুধবার ও গতকাল বৃহস্পতিবার কার্ব মার্কেট বা খোলাবাজারে নগদ ডলার নেমে এসেছে ১১০ থেকে ১১১ টাকায়। গত সপ্তাহে যা উঠেছিলো ১২০ টাকা পর্যন্ত। এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলাবাজারে ডলারের দাম কমেছে ১০ টাকা। খুচরা ডলার বিক্রেতারা জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার যারা বিক্রি করবে তাদের ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা রেট দিচ্ছি। আর ডলার কিনলে ১১০ টাকা নিচ্ছি। কারণ এখন বাজার ভাটা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, মানি চেঞ্জারদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গড় রেট থেকে এক টাকা বেশি দামে ডলার ক্রয় করে সর্বোচ্চ দেড় টাকা মুনাফা করতে বলা হয়েছে। নিয়ম না মানলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ডলারের সংকট কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি শিগগিরই বাজার স্থিতিশীল হয়ে যাবে।
মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এর মহাসচিব মো. হেলাল সিকদার বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তারা মুনাফার হার সর্বোচ্চ দেড় টাকা পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছে।’ এছাড়াও ডলারের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছে বলে তিনি জানান।
আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলার ৯৫ টাকায় বিনিময় হয়েছে। যদিও এখনও খোলাবাজারে প্রতি ডলার ১১০ টাকা থেকে ১১৫ টাকা দর পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে এখন ডলারের দাম কিছুটা কমে এসেছে। চলতি আগস্ট মাসের প্রথম ১৬ দিনে দেশে ১১৭ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। যা ডলারের বাজারে বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও সচেতন মহল।
ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোকে মুনাফার হারও নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংক যে দরে ক্যাশ ডলার বিক্রি করবে, সেই দরকে বেঞ্চ মার্ক ধরে তার চেয়ে ১ টাকা বেশি দরে কিনতে পারবে এবং সর্বোচ্চ ১.৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করতে পারবে মানি এক্সচেঞ্জগুলো। ব্যাংকগুলো ১ টাকা বেশি দামে বিক্রি করতে পারবে।
অর্থনীতিবিদদের সমালোচনার মুখে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ডলার সংরক্ষণ করে দর বৃদ্ধির প্রমাণ ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচলাকদের (এমডি) কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে ওই ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি প্রধানদেরও অপসারণের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এবিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন বলেন, ‘একটি বহুজাতিক ব্যাংক ও পাচটি দেশিও ব্যাংকের এমডিকে গত বুধবারই নোটিশ পাঠিয়েছেন। তাদের কাছে থেকে সুনির্দিষ্ট কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে। এছাড়া ডলারে অতিরিক্ত মুনাফা করার সঙ্গে কোন কোন ব্যক্তি জড়িত তা প্রাথমিকভাবে ব্যাংকই বের করবে।
মুখপাত্র আরো বলেন, আরো ৮টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি রয়েছে। তাদের ট্রেজারি প্রধান ও এমডিদের নোটিশ করা হতে পারে। তবে ওই আট ব্যাংকের নাম প্রকাশ করেননি তিনি। এর আগে ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ডাচ বাংলা ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের ‘ট্রেজারি অপারেশনে’ অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক পেয়েছে। গত বুধবার তাদের এমডিদের কৈফিয়ত তলবের বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করা হলে কোনো ব্যাংকই সাড়া দেয়নি।
ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তায় শুধু বলেছেন, ‘নো কমেন্টস’। আর বহুজাতিক ব্যাংক স্টান্ডার্ড-চার্টার্ড বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয় এক এসএমএসের মাধ্যমে বলেছেন, ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী, ‘তদন্তাধীন বিষয়ে’ কোনো মন্তব্য তিনি করবেন না। বাকি চার ব্যাংকের এমডিদের কেউ ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও সাড়া দেননি।
ব্যাংকগুলোর বিদেশি মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স, বিদেশি মুদ্রায় আমানত সংগ্রহ এবং বিভিন্ন ধরনের বন্ডে বিনিয়োগ। আবার বিদেশি প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে কোনো কোনো ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোন ব্যাংক কী পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা সংরক্ষণ করতে পারবে, তার একটি সীমা (এনওপি-নেট ওপেন পজিশন) নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।
আগে ব্যাংকের রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি মুদ্রা সংরক্ষণ করার সুযোগ ছিল। ডলার বাজারের অস্থিরতা কমাতে গত ১৫ জুলাই তা কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়াও সীমার বেশি ডলার হাতে থাকলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্য কোনো ব্যাংকের কাছে বিক্রি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে ব্যাংকগুলোর।
আনন্দবাজার/শহক