সোনালি আঁশখ্যাত দেশের এক সময়ের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট নিয়ে দুশ্চিন্তা শেষই হচ্ছে না। একদিকে বড় সম্ভাবনার হাতছানি অন্যদিকে নানা সংকটে চাষিদের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে পাটের সোনালি স্বপ্ন। বিশেষ করে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে তীব্র খরার কবলে পড়ে এবার জাগ দেয়ার পানি সংকট বিপাকে ফেলেছে পাটচাষিদের। এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন পাটকল মালিকরা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, অধিক ফলনশীল নতুন জাতের পাট বীজ উদ্ভাবন না হওয়া, ভেজানোর জলাশয় না থাকার কারণে চাষিরা দিন দিন পাট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। পাট আর পাটজাত পণ্যের রপ্তানিও আগের চেয়ে কমে গেছে। একই সঙ্গে কমেছে বৈদেশিক আয়ও। আর সেই ধাক্কা এসে লেগেছে পাটকলগুলির ওপর।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ইতোমধ্যে দেশের অর্ধেক পাটকলই বন্ধ হয়ে গেছে। সেই ধারাবাহিকতায় উত্তরের প্রবেশদ্বারখ্যাত শিল্পের শহর বগুড়ার পাটকলগুলোর অবস্থাও নাজুক। জেলায় বর্তমানে ১৪টি পাটকল থাকলেও সচল রয়েছে মাত্র ১০টি। একের পর এক পাটকল বন্ধের কারণ হিসেবে মালিকরা পাটের সংকট আর দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পলিথিনের অতিরিক্ত ব্যবহারকেই দায়ি করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে আর অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে না পারলে সচল পাটকলগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে জেলার বিভিন্ন পাটকলে কর্মরত প্রায় ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন।
সূত্রমতে, বিশ্বখ্যাত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আদমজী পাটকল ২০০২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেখানকার ছোট ছোট যন্ত্রাংশ কিনে এনে বগুড়ায় বেসরকারি পর্যায়ে পাটকল গড়ে তোলা হয়। তারপর থেকে একে একে গড়ে ওঠে প্রায় ১৮টি পাটকল। যেসব কারখানায় তৈরি করা হয় বস্তা, ব্যাগ, সুতলি, চট। যা জেলার প্রয়োজন মিটিয়ে অন্য জেলাতেও বিক্রি করা হয়। তবে পাটের মৌসুমে প্রয়োজনীয় পাট পেলেও মৌসুমের পর পাটের অভাবে বেশিরভাগ সময় বন্ধ রাখতে হয় উৎপাদন। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলার পর লাভের মুখ দেখা বন্ধ হয়ে যায়।
পাট অধিদপ্তর বগুড়া অফিসের তথ্যমতে, জেলায় বর্তমানে যে ১৪টি কারখানা রয়েছে তার মধ্যে ৪টিই বন্ধ রয়েছে। বাকি যে ১০টি সচল রয়েছে সেগুলোতে উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পাটকল মালিকদের অভিযোগ, বিদেশে পাটের পণ্য পাঠাতে সরকারি পদক্ষেপ তেমন নেই। তাছাড়া আগের চেয়ে পাটজাত পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে। যে কারণে পুরোদমে সচল রাখা যাচ্ছে না পাটকলগুলি। যদিও বগুড়ার কর অঞ্চলের দেয়া তথ্যমতে, কৃষিপণ্য উৎপাদন হওয়ায় পাটকলগুলোতে কর অনেক সময় মওকুফ করা হয়। তবে সেই সুবিধা সামান্যই বলে দাবি মালিকরদের।
এমন হতাশাজনক পরিস্থিতির কারণ হিসেবে পাটকল মালিকরা পাটের ঊর্ধ্বগতির দিকে আঙ্গুল তুলছেন। এ ব্যাপারে বগুড়া সদরের ঠেঙ্গামারা প্রগতি পাটকলের ব্যবস্থাপক বিদ্যুৎ কুমার চাকির ভাষ্য, একে তো পাটের দাম বেশি, তার ওপর আবার মানুষ পলিথিনের পণ্য ব্যবহার বেশি করছে। এতে বেশি দামে পাট কিনে পাটপণ্য বেচতে হচ্ছে কম দামে। আবার রপ্তানিও কমে এসেছে। ফলে কয়েক বছর ধরেই লোকসান দিতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে স্থায়ীভাবেই বন্ধ করে দিতে হবে পাটকল।
এদিকে, পাটকলগুলোতে লোকসানের কারণে শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছে। শ্রমিকরা বলছেন, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। কোনো পাটকলে বেতন দেওয়া হয় মাসিক হিসেবে। আবার কোনোটাতে সাপ্তাহিক আবার কোনোটাতে দেওয়া হয় দিন হাজিরা হিসেবে। এ নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে শ্রমিকদের।
জেলার একটি পাটকলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিক জানান, এখানে দিনহাজিরা সর্বোচ্চ ২৯০ টাকা দেওয়া হয়। তবে সেটিও নিয়মিত নয়। কারখানা একসপ্তাহ বন্ধ রেখে পরের সপ্তাহ চালানো হয়। বন্ধ থাকা সপ্তাহে শ্রমিকরা পড়েন অর্থসংকটে। কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে পরিস্থিতিকে দায়ী করছেন। দেশের নিত্যপণ্যের বাজার যখন ঊর্ধ্বগতিতে, পাটকলে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক তখনও অনিয়মিত এবং নিম্নমুখি হওয়ায় শ্রমিকরা দিন দিন পাটকল বিমুখ হচ্ছেন। ফলে শ্রমিক সংকটেও পড়তে হচ্ছে মালিকদের।
অবশ্য পাটকল মালিকরা পাটের দাম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেও চাষিদের মুখে হতাশার সুর। তাদের অভিযোগ, পাটের দাম তারা তুলনামূলক কম পাচ্ছেন। বগুড়া সদরের শেখেরকোলা ইউনিয়নের পাটচাষি মিল্লাত হোসেন জানান, দীর্ঘদিন ধরে পাটচাষ করে এলেও কয়েক বছর ধরে দাম পাচ্ছেন না। এর ওপর আবার জাগ দেওয়ার জন্য আশপাশে যেসব ডোবা বা পুকুর ছিল সেগুলোও ভরাট হয়ে গেছে। এতে পাট চাষই ছেড়ে দিচ্ছেন অনেকে। যুমনাতীরের উপজেলা সারিয়াকান্দির চরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পাট চাষ হয়ে থাকে। হাটশেরপুর চরের মাল্লিক মাঝি জানান, অন্যান্য পণ্যের তুলনায় পাটের দাম খুব কম পাওয়ায় আসছে বছর থেকে পাটচাষ ছেড়ে দেবেন।
কৃষি অধিদপ্তর বগুড়ার তথ্যমতে, চলতি বছরে বগুড়ায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে পাটচাষ হয়েছে। দামও আগের তুলনায় বেড়েছে। প্রতিমণ পাট এবার দুই হাজার পাঁচশ থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাট অধিদপ্তর বগুড়ার মূখ্য পরিদর্শক সোহেল রানা বলেন, বগুড়ায় ১৪টি পাটকলের মধ্যে ৩/৪টি প্রায় বন্ধ রয়েছে। গড়ে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন এসব পাটকলে। পাটের দাম বেশি দেখিয়েই মালিকরা উৎপাদন বন্ধ রাখছেন। বিশেষ করে নতুন মৌসুমের আগের সময়গুলোতে পাট সংকটে পড়ছেন তারা। তবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়লে পাটকলগুলো সচল হতে পারে।
- প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাহাতুল আলম রাহাত
আনন্দবাজার/শহক