- জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি অবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত
- বেতন না বাড়ালে শ্রমিক অসন্তোষের শঙ্কা
দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট শুধুমাত্র যুদ্ধের প্রভাবে নয়, বরং বৈদেশিক খাতের যেসব সংকট দেখা যাচ্ছে তা রোগের উপসর্গ মাত্র। দীর্ঘকাল ধরে আর্থিক খাতের সংস্কার না হওয়াই বর্তমান পরিস্থিতির আসল খলনায়ক। আর উপসর্গ নিয়ে বেশি আলাপ হলেও মূল সমস্যায় নজর কম পড়ছে বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিকে অবিবেচনাপ্রসূত আখ্যা দিয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে একটি দরিদ্র সরকার বলে মন্তব্য করেন এ অর্থনীতিবিদ। এ সংকট থেকে পার পেতে উত্তরণকালীন একটি অর্থনৈতিক নীতি সমঝোতার আহ্বান জানান। বর্তমান সংকট ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলবে বলেও মনে করেন তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার অনলাইনে ‘বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় একটি উত্তরণকালীন নীতি সমঝোতার খসড়া’ শিরোনামে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব মন্তব্য করেন। বর্তমান সময়েই ভর্তুকি সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাহলে কি সরকার আইএমএফের লোনের জন্য ভর্তুতি তুলে নিল?- এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, যদি তাই হয় তাহলে তা সরকারের নিজস্ব অবস্থান হারানোর মতো অবস্থা। আর এটা কোন সম্মানজনক বিষয় নয়। এক দশকেও সরকারের আর্থিক সক্ষমতা তৈরি হয়নি। আর এখন অর্থের জন্য সব জাগায় যেতে হচ্ছে- তাহলে উচ্চ প্রবৃদ্ধির আয় কোথায় সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।
উত্তরণকালীন অর্থনৈতিক সমঝোতা কাদের কে, নিয়ে হবে কীভাবে হবে-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিপিডির সাবেক প্রথম নির্বাহী পরিচালক বলেন, সরকারের নিজের ভিতর আলোচনা দরকার। এককেজন মন্ত্রী একেক ধরণের কথা বলছেন। ফলে তাদের ভেতর কোনো আলোচনা নেই তা বুঝা যাচ্ছে। প্রথমে সরকারের ভেতর আলোচনা শুরুর তাগিদ দেন তিনি। এক্ষেত্রে মন্ত্রীপরিষদ, সংসদ এবং স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হওয়া দরকার। এমন একটি সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটি কোন ধরণের কোন আলোচনা করেনি বলেও অভিযোগ এ গবেষকের। দ্বিতীয়ত সংশিষ্ট পেশাজীবিদের সাথে এবং রাজনৈতিক সহযোগীদের সাথেও আলোচনা হতে পারে। সবার কথা না মানলেও সবার কথা শোনা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও দরিদ্রদের সুরক্ষা প্রদানের জন্য এ সমঝোতা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। নয়তো সামনে রাজনৈতিক সমস্যা বাড়লে উপাদন বাধাগ্রস্থ হতে পারে। সরকারের বর্তমান পদক্ষেপকে বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিত আখ্যা দিয়ে আমলানির্ভর নীতি নির্ধারণ হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। আগামী ২-৩ বছরের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনার পরামর্শ দেন তিনি। বাজেটে ঘোঘিত ৬ চ্যালেঞ্জের আরো অবনতি হচ্ছে বলেও তিনি উপস্থাপন করেন।
অর্থনৈতিক উত্তরণের জন্য বর্তমানে দেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একধরণের ঐক্য দেখছেন তিনি। পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কিছু পরামর্শ দেন তিনি। তার মধ্যে রয়েছে- সুদের হার ৯-৬ থেকে তুলে দিয়ে কম বেশি করা। ক্যাপাসিটি চার্জের কাঠামো ন্যায্যতার ভিত্তিতে পুর্নগঠন করা। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে সেটা খারাপ ভর্তুকি হিসেবে মন্তব্য তার।
এসব পদেক্ষেপে বিনিয়োগ কিছুটা কম হলেও সমস্যা উতরে যেতে মাথাটা কিছুটা নীচু করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি। কিছু ক্ষেত্রে আমদানি বন্ধ করা যেতে পারে। শুরু হয়নি এমন মেগা প্রকল্প নতুন করে শুরু না করা। সার- ডিজেলে কৃষির সুরক্ষা নিয়ে ভাবতে বলেন। শ্রমিকদের বেতন না বাড়ালে শিল্প অসন্তোষ শুরু হওয়ার আশঙ্কাও করেন তিনি।
এদিকে সবচেয়ে অসুবিধায় পড়া মানুষদের জন্য ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে সহায়তা করা। জেলা পর্যায়ে টিসিবি ট্রাক পাঠানো। যুব বেকারত্ব আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করে তাদের জন্য এককালীন সহায়তার প্রস্তাব করেন। যে সরকার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে পারে, খেলাপীদের ঋণ মওকুফ করতে পারে, শেয়ার বাজার ধসে সহায়তা করতে পাতে সে সরকারকে যুবকদের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান এ অর্থনীতিবিদ।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য সরকার যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছে শুধু তা দিয়ে পুরো পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে মোকবিলা করা যাবে না। বৈশ্বিক পরিস্থিতি সব দেশকে আঘাত করেছে। কিন্তু অনেকেই এই পরিস্থিতি যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পারছে। আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এখন যদি আমাদের কর জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশ থাকতো তাহলে বর্তমানের এতো চাপ তৈরি হতো না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের চেয়ে যা কম।