ঢাকা | রবিবার
২৫শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শর্তের কাঁটাবিদ্ধ ঋণ

শর্তের কাঁটাবিদ্ধ ঋণ

আইএমএফে নাকাল ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড

  • পাইপ লাইনে শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান

আইএমএফের ঋণ প্যাকেজ দেশের বাজারকে স্থিতিশীল করবে: আহসান এইচ মনসুর, সাবেক অর্থনীতিবিদ, আইএমএফ

বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার বৈদেশিক ঋণ নিতে যাচ্ছে। তবে প্রথমে ঋণের বিষয়টি চেপের রাখার চেষ্টা করা হলেও পরে স্বীকার করে নেন অর্থমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পেতে চিঠি পাঠানোর কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আইএমএফ কী শর্তে ঋণ দিতে চাচ্ছে, তা দেখতে হবে। আইএমএফকে ইতিবাচক দেখা গেলে সংস্থাটি থেকে ঋণ নেওয়ার কথা বিবেচনা করা যায়।

সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে বুধবার অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত দেখে অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা করা হয়। ঋণ দরকার। একসময় বলেছিলাম ঋণ শুধু আমরা নেব না, ঋণ দেবও। আবারও বলছি ভবিষ্যতে ঋণ দিতে পারব আমরা।

অর্থের প্রয়োজনে সব জায়গায় যাওয়ার কথা বলে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংকে যাব, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থায় (জাইকা) যাব। তবে আমরা সব সময় চেষ্টা করি কম সুদে ও সহজ শর্তে ঋণ নিতে। এবার চিঠি দেওয়া হয়েছে আইএমএফকে।

দেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ১৫.১২ শতাংশ। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাণিজ্যঘাটতি এখন ৩ হাজার ৮৬ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাণিজ্যঘাটতি। আমদানি ব্যয় ও প্রবাসী আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির কারণে চলতি হিসাবের ঘাটতি এখন ১ হাজার ৭২৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এটিও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আর সব মিলিয়ে সামগ্রিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৩৭১ কোটি ডলার। অথচ আগের অর্থবছরেও ছিল ৭৫০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত। অর্থনীতির এই চিত্র আইএমএফকে দেওয়া চিঠিতেও উল্লেখ করা হয়েছে।

মূলত সরকারের সব ধরনের আয় কমে গেছে। জ্বালানি সংগ্রহে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানির সংকটে আছে দেশ। কমাতে হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। বহু বছর পরে লোডশেডিংয়ের অভিজ্ঞতা নিতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। এর বাইরে দৃশ্যমান আরেকটি বড় সংকট হচ্ছে ডলারের দাম। বিশ্ববাজারেই ডলার প্রতিদিন শক্তিশালী হচ্ছে। দেশের মধ্যে সরকারকেও এখন টাকার অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে। গত জানুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। তবে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে খোলাবাজারে। খোলাবাজারে ডলারের দর উঠেছে ১১২ টাকা পর্যন্ত। সব মিলিয়ে চাপ পড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভে। তাই ঋণ নিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অজনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান মনে করা হয় আইএমএফকে। অনেক সরকারও সহজে যেতে চান না আইএমএফের কাছে। ১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়া সংকটের সময় আইএমএফের দ্বারস্থ হয়েছিল ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। তখন আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে আরও বিপদে পড়ে যায় তারা। অর্থনীতির মন্দা আরও তীব্র হয়েছিল, বেড়েছিল বেকারত্ব। ২০০১ সালে আর্জেন্টিনাকে উদ্ধারে নেমেছিল আইএমএফ। সেটিও ছিল আইএমএফের জন্য বড় ব্যর্থতা। বাংলাদেশ ছাড়াও আইএমএফের ঋণ পেতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিপদে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান।

এদিকে ব্লুমবার্গ বলছে, বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের ঋণ রিজার্ভ বাড়ানোর কৌশল। ঢাকা-ভিত্তিক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আইএমএফের একটি ঋণ প্যাকেজের অনুমোদন বাংলাদেশের বাজারকে স্থিতিশীল করবে। এতে আমরা কিছু তহবিল পাবো, যা আমাদের রিজার্ভ বাড়াবে। এটিই সেরা কৌশল।

অন্যদিকে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগো বলেছিলেন, ‘বিশ্ব যে তিনটি প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে—বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও), তারা কেউই গণতান্ত্রিক নয়।’ নোবেল পাওয়া অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ বহু বছর ধরেই আইএমএফের বড় ধরনের সংস্কার চেয়ে আসছেন।

অর্থনীতিবিদদের একটি অংশ আগে থেকেই আইএমএফের ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিল। তাদের যুক্তি ছিল দুটি। যেমন অর্থনীতি আইএমএফের নজরদারিতে থাকলে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের আস্থা বাড়বে এবং সরকার বাধ্য হয়ে সংস্কার করবে।

গত দুই দশকে বাংলাদেশে কার্যত বড় কোনো সংস্কার হয়নি। এখন আইএমএফের শর্ত মেনে সেসব সংস্কার করতে হবে। এর অনেকগুলোই জনপ্রিয় হবে না। বিশেষ করে ভর্তুকি হ্রাস, কর মওকুফ–সুবিধা তুলে নেওয়া, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি। সুতরাং ঋণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হলে বাংলাদেশ আইএমএফকে কী ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়, সেটাই হবে দেখার বিষয়।

২০১২ সালে ঋণ নেওয়ার সময় বাংলাদেশকে দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে ছিল রাজস্ব প্রশাসনে সংস্কার। এর আওতায় বাংলাদেশকে নতুন ভ্যাট আইন পাস করতে হয়েছিল। তখন একটি নতুন প্রত্যক্ষ কর আইন তৈরির শর্তও ছিল, যদিও তা এখনো পাস হয়নি। কর মওকুফ–সুবিধা বাতিলের শর্তও ছিল সংস্থাটির। অন্যান্য শর্তের মধ্যে ছিল সরকারের ভর্তুকি ব্যয় কমানো, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার বৃদ্ধি, বিনিময় হার আরও নমনীয় করা, খেলাপি ঋণ আদায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি ক্ষমতা বাড়ানো, বাণিজ্যের বাধা দূর করা, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি ইত্যাদি।

এর আগে বাংলাদেশ সর্বশেষ আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল ২০১২ সালে। সম্প্রসারিত ঋণ কর্মসূচির (ইসিএফ) আওতায় তিন বছরের জন্য নেওয়া হয়েছিল ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সে সময় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) হার ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছিল ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। আর চলতি হিসাবে এবং সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যেও ঘাটতি দেখা দিয়েছিল।

তখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বা ৯৩০ কোটি ডলার। এই রিজার্ভ দিয়ে ২ দশমিক ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। সে সময় বাংলাদেশ সংকটে পড়েছিল মূলত আমদানির ক্ষেত্রে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়েছিল। দেশের মধ্যেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। এতেই মূল্যস্ফীতি বাড়ে। এখান থেকে উদ্ধার পেতেই আইএমএফের কাছে যায় সরকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন