এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার চার থেকে সাড়ে চার ভাগ আমন রোপণ
–মাহাবুবুর রহমান, উপ-পরিচালক, আঞ্চলিক কৃষি অফিস, রংপুর
বৃষ্টির অপেক্ষায় আষাঢ় শেষ। এখন চলছে শ্রাবণ। তবুও দেখা নেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির। ভরা বর্ষাকালে অনাবৃষ্টির কারণে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষক আমজাদ হোসেন। আমন আবাদের প্রস্তুতি নিলেও শুধু বৃষ্টি না হওয়ায় মরতে বসেছে তার বীজতলা। অর্থাভাবে এই কৃষক আমন আবাদে সম্পূরক সেচ দিতেও পারছেন না।
তবে আমজাদ হোসেন হাত গুটিয়ে নিলেও বসে নেই অন্যরা। কৃষক আব্দুর রাজ্জাক ধার দেনা করে সেচের পানিতে শুরু করেছেন চাষাবাদ। তার মতো উত্তরের লাখ লাখ কৃষক এখন বাড়তি খরচের ধকল মেনে সম্পূরক সেচে আমন আবাদে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়নের প্রতিপাল বগুড়াপাড়া গ্রামের কৃষক আমজাদ হোসেনের মতো হাজারো কৃষকের এবার স্বপ্ন ভঙ্গ হতে বসেছে। বৃষ্টির জন্য আকুতি তাদের। তবে যাদের সামর্থ্য আছে, তারা আব্দুর রাজ্জাকের মতো বাড়তি খরচ জেনেও সেচ দিয়েই আমন রোপণ করছেন।
আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন উত্তরের কৃষির জন্য অশনি সংকেত
–একেএম কামরুল হাসান, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আবহাওয়া অফিস, রংপুর
কৃষি বিভাগ ও আবহাওয়া অফিস বলছে, স্মরণকালের একটানা দাবদাহ চলছে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে। গত ২০ দিন ধরে তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠা-নামা করছে। এখনো দেখা নেই বর্ষার। নেই কালো মেঘের ঘনঘটা। প্রখর রোদ আর গরমে বর্ষণের গর্জন শূন্য মেঘ। এতে উত্তরাঞ্চলের বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণে ভরা বর্ষায় দেখা দিয়েছে খরা।
আমন লাগানোর এই মৌসুমে সৃষ্ট খরায় এখন পর্যন্ত সম্পূরক সেচ দিয়ে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র চার ভাগ আবাদ হয়েছে। বৃষ্টি না হলে আব্দুর রাজ্জাকের মতো বাড়তি খরচের বোঝা ঘাড়ে নেওয়া কৃষকদের গুনতে হবে অতিরিক্ত প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। উত্তরের কৃষি ও কৃষকের জন্য এমন বাড়তি খরচ আর প্রকৃতির বিরূপ আচরণকে অশনি সংকেত বলছেন আবহাওয়াবিদরা।
রংপুর সদরের চন্দনপাট ইউনিয়নের চাপরার বিল। যেখানে আষাঢ়-শ্রাবণে থই থই করে পানি। তবে এবার এই বিলের পানি খরতাপে পুড়ে শূন্য হওয়ার পথে। রেকর্ড ভাঙা দাবদাহে উঁচু জমিগুলোর অবস্থা আরও বেহাল। জমি ফেঁটে চৌচির। আমনের বীজতলারও সময় শেষ। সেচ দিয়ে রোপণ করলে বাড়তি খরচ হচ্ছে। আবার বিলম্বে আমন লাগালে ফলনও হবে কম। এবারের এই ভিন্ন পরিস্থিতিতে আমন চাষ নিয়ে চিন্তিত উত্তরের মানুষ।
এরই মধ্যে খরা ও অনাবৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাটসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলায় ইস্তিসকার নামাজ আদায় করেছেন হাজার হাজার কৃষকসহ ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। নামাজ শেষে অব্যাহত অনাবৃষ্টি থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করে হু হু করে কেঁদেছেন। গেল কয়েক দিনে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু এলাকায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হলেও কাঙিক্ষত বর্ষণ শুরু হয়নি। তীব্র রোদ উপেক্ষা করেই এখন চলছে জমি তৈরির কাজ। কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে রোপন। তবে রোদের তীব্রতার চেয়ে বাড়তি খরচের ধকলে পুড়ছেন কৃষকরা।
চন্দনপাট ইউনিয়নের শ্যামপুর বাজার এলাকার কৃষক এরশাদ মিয়া বলেন, ‘জীবনে হামার এত্তি চাপরার দোলার পানি শুকায় নাই। কিন্তু এবার রেকর্ড ফেল। বৃষ্টিও নাই, পানিও নাই। আমন যে রোপণ করমো, তার জন্য বাড়তি টাকা ছাড়া উপায় নাই। এ্যালা পানি নেওবার গেইলে দোন প্রতি কমপক্ষে ২ হাজার ৫০০ টাকা লাগোছে।’
একই এলাকার কৃষক মোজাহার আলী বলেন, ‘বৃষ্টির পানি নাই। আবাদ করমো কেমন করি। আকাশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। বর্ষাকালেও বৃষ্টি হওছে না। আর কত দিন অপেক্ষা করমো। বেশি দিন বীজতলা পড়ি থাকলে মরি যাইবে। ওই তকনে মেশিনের পানি দিয়্যা আবাদ করা শুরু করছি। খরচ বেশি হওছে। কিন্তু হামরা তো গরিব মানুষ। চাষাবাদ না করলে খামো কী। আল্লাহ্ যদি সহায় হয়, বৃষ্টি হইলে খরচ কমবে।’
মূলত আষাঢ়ের বৃষ্টিই ভরসা আমন চাষিদের। তবে এবার আষাঢ় শেষে শ্রাবণের সাতদিন পেরিয়ে গেলেও হতাশ হতে হয়েছে উত্তরের কৃষকদের। বৃষ্টি নেই তাই সেচের উপরই এখন নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন কৃষকরা। সেচের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে শ্রমিকের বাড়তি মজুরি ও চাষের খরচ।
আগামী ২৫ জুলাইয়ের আগে আমন লাগাতে না পারলে ফলন কাঙ্ক্ষিত হবে না। তাই বদরগঞ্জের নান্দিয়ার বিলের কৃষক আব্দুস সালাম গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচে আবাদ করছেন। এতে প্রতি একরে তার বাড়তি খরচ পড়ছে হাজার টাকার ওপরে। এই কৃষক বলেন, ‘বৃষ্টির পানি না থাকার কারণে মেশিন লাগাইছি। অন্যরাও একইভাবে পানি নিতেছে। তেল, পানি ও মেশিনের ভাড়া তো আছেই। এখন বাড়তি খরচ এক হাজারের বেশি। খাবার জন্য হলেও তো খরচ করে আবাদ করতে হবে। তা ছাড়া আমাদের উপায় নাই।
আবহাওয়া অফিস বলছে, জুলাই মাসে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় ৪৫৩ মিলিমিটার। কিন্তু গেল ২০ দিনে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার। এই সময়টাতে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। তবে গেল ২০ দিনে রংপুর বিভাগে ২৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। মৌসুমের এ সময়টাতে স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি তাপমাত্রা বাড়লেও তা ২ থেকে ৩ দিনের বেশি স্থায়ী হওয়ার কথা নয়। তবে এবার এর ব্যতিক্রম ঘটেছে।
রংপুর বিভাগে ২০২০ সালে জুলাইয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৮০৪ মিলিমিটার। তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল সর্বোচ্চ ৩৪ দশমিক শূন্য ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পরের বছর ২০২১ সালে বৃষ্টি হয়েছিল ১৯৬ মিলিমিটার, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪ দশমিক ৪ এবং সর্বনিম্ন ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বছর চলতি মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ১৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার । তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বনিম্ন ২৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। টানা ২০ দিন ধরে স্বাভাবিকের থেকে তাপমাত্রা বেশি ছিল ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।
আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন উত্তরের কৃষির জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম কামরুল হাসান। তিনি বলেন, স্বাভাবিক বৃষ্টি না হলে আমন চাষে তিন ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষকরা। প্রথমত সেচে বাড়তি খরচ, দ্বিতীয়ত ক্ষেতে আগাছা, রোগ বালাই ও পোকার আক্রমণ বেড়ে যায় এবং তৃতীয়ত উৎপাদিত ধানে ভালো মানের চাল পাওয়া যাবে না।
এদিকে কৃষি বিভাগের দাবি, এই অঞ্চলে ৯ হাজার গভীর ও চার লাখ অগভীর নলকূপ রয়েছে। সম্ভাব্য খরার শঙ্কায় সেচ নালা নষ্ট না করার পরামর্শ ছিল কৃষকদের প্রতি। যথা সময়ে আমনের চারা রোপণ করা না হলে কাঙ্ক্ষিত ফলন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে কারণেই আমন আবাদে কৃষকদের সম্পূরক সেচের পরামর্শ দেওয়া ছিল। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সে কারণেই কৃষকদের বন্যা ও খরা সহিষ্ণু ধান আবাদেও উৎসাহিত করছেন।
এবার রংপুরসহ উত্তরের ১৬ জেলার চারটি কৃষি জোনে প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে এখন পর্যন্ত এর মধ্যে আবাদ হয়েছে মাত্র এক লাখ হেক্টরে। সেটিও করতে হয়েছে সম্পূরক সেচ দিয়ে। বাকি জমিগুলো সম্পূরক শেষ দিয়ে আবাদ করতে গেলে কৃষকের এবার বাড়তি খরচ হবে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে এই অংক আরও বাড়বে।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপ-পরিচালক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ধানের আবাদ যাতে পিছিয়ে না যায়, এজন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বোরো ধানের ক্ষেত্রে কৃষকরা শতভাগ সেচ নির্ভর। কিন্তু আমনের বেলায় বৃষ্টির পানির ওপরেই বেশি নির্ভরশীল তারা। এবার যেহেতু পরিস্থিতি ভিন্ন, তাই সম্পূরক সেচের দিকেই অনেকে ঝুঁকছেন। এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র চার থেকে সাড়ে চার ভাগ আমন রোপণ হয়েছে।
আনন্দবাজার/শহক