ফিরেছে বিলুপ্তপ্রায় ৩৬ প্রজাতির মাছ
- মুক্ত জলাশয়ে মৎস আহরণে বিশ্বে তৃতীয়
মিঠা পানির মাছ, সামুদ্রিক মাছ সব ক্ষেত্রে আমাদের অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। বিগত ১৬ বছরের ব্যবধানে মাছের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ মৎস্যখাতের অবদান বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর মৎস্য ভবনে মৎস্য অধিদপ্তরের সভা কক্ষে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২২ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ ৩য়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম, ইলিশ উৎপাদনে ১ম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে ৪র্থ স্থানে রয়েছে। এ অর্জন সম্ভব হয়েছে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে।
মৎস্যখাতে বাংলাদেশ একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী এ সময় বলেন, এখন আমাদের লক্ষ্য নিরাপদ মাছ উৎপাদন। শুধু মাছের উৎপাদন বাড়ালেই হবে না, নিরাপদ ও পুষ্টিকর মাছ উৎপাদনে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। ভোক্তার কাছে আমরা নিরাপদ মাছ পৌঁছে দিতে চাই। এ লক্ষ্য নিয়ে গতকাল ২৩ থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২২ উদযাপন হচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, একটা সময় মৎস্যখাতে যথাযথ পরিচর্যা না হওয়ায় ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় মাছের আকাল দেখা দিয়েছিল। আমাদের নিজস্ব যেসব মাছ তার একটা বিশাল অংশ হারিয়ে গিয়েছিল। ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ৩৬ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছ আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মাছ যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য ময়মনসিংহে লাইভ জিন ব্যাংক করা হয়েছে, যেখানে শতাধিক প্রকারের মাছ থাকবে। কোথাও কোন মাছ হারিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলে তার রেণু ও পোনা ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। এছাড়া নিজস্ব গবেষণা থেকে সুবর্ণ রুই নামক একটি দ্রুত বর্ধনশীল ও অধিক উৎপাদনশীল মাছ উদ্ভাবন করা হয়েছে।
মন্ত্রী আরও বলেন, বন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশাল সমুদ্র জয়ের পর এর অভ্যন্তরে কত প্রকার মাছ আছে, কী সম্পদ আছে, প্রচলিত-অপ্রচলিত মাছ আছে সেগুলো অনুসন্ধান করার জন্য আমাদের মীন সন্ধানী জাহাজ কাজ করছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রচলিত-অপ্রচলিত বিশাল মৎস্য ভান্ডার রয়েছে। এই মৎস্যসম্পদ এক সময় আমাদের বড় ধরনের আয়ের উৎস হতে পারে। সে জায়গায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও আওতাধীন দপ্তরসমূহ কাজ করছে। সমুদ্রসীমায় আমাদের কূটনৈতিক সাফল্যের ধারাবাহিকতায় গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
মাছ রপ্তানির প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ইলিশ পূর্বেই আমাদের ভৌগলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য ছিল। ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নতুন সংযুক্ত হয়েছে আমাদের বাগদা চিংড়ি। বিশ্বপরিমণ্ডলে বাগদা এখন বাংলাদেশের হিসেবে পরিচিত। এটি বিশ্বপরিমন্ডলে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। পৃথিবীর প্রায় ৫২টি দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের মাছের চাহিদা রয়েছে। এসব দেশে বিভিন্নভাবে মাছ রপ্তানি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ও তার সরকারের ব্যবস্থাপনায় মাছের মান নিয়ন্ত্রণে দেশে তিনটি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। এখানে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হবে। কোনো দেশেই যাতে মাছের সাথে বিষাক্ত উপাদান না যায়, এটা আমরা নিশ্চিত করছি।
করোনায় বিশ্বের অনেক দেশের মৎস্য খাতে বিপর্যস্ত অবস্থা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী জানান, এ সময় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তিনটি দেশ মৎস্য উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে। এ তিনটি দেশের একটি বাংলাদেশ, অপর দুটি দেশ মিশর ও ভিয়েতনাম। করোনার সময় মৎস্য উৎপাদনকারীরা বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়লে তাদের জন্য সরকার ভ্রাম্যমান বিক্রয় ব্যবস্থা চালু করেছে। সে সময় মাছের খাদ্য বিদেশ থেকে আনার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিকূলতা ছিল সেগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী জানান, মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকাকালে যাতে মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য তাদের পর্যাপ্ত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বিকল্প কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার জন্য বিনামূল্যে বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া হচ্ছে, প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লক্ষ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৫ লক্ষ ৬৫ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। ইলিশের উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করতে সরকার কাজ করছে। যাতে দেশের সব প্রান্তিক মানুষ ইলিশের স্বাদ নিতে পারে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব শ্যামল চন্দ্র কর্মকার ও মো. আব্দুল কাইয়ূম, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মো. হেমায়েৎ হুসেন, মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদসহ মন্ত্রণালয় ও মৎস্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এদিন সকালে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২২ এর কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।