ঢাকা | মঙ্গলবার
৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মৃতদের অনুদানে দালালদের থাবা

মৃতদের অনুদানে দালালদের থাবা
  • ডিসির কাছে অভিযোগ, ভুক্তভোগীদের হুমকিধামকি

হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের নছরতপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬ জনের স্বজনের নামে বরাদ্দ করা সরকারি অনুদানের টাকা আত্মসাত করেছে একটি দালাল সিন্ডিকেট চক্র। চক্রটি নিহতদের স্বজনদের নামে বরাদ্দকৃত জনপ্রতি দুই লাখ টাকা করে না দিয়ে ৪ জনের কাছ থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু তাহেরের মাধ্যমে সালিশ বৈঠক বসিয়ে চক্রটি স্বজনদের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চুনারুঘাট উপজেলার শ্রী বাউর গ্রামের রাহেলা খাতুনের মা মোছা. মিনারা খাতুন ও আব্দুর করিম রাজুর ভাই আব্দুর রাহিম রাজ।

এদিকে, ওই দালালদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান। গতকাল বুধবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, গতবছরের ২১ আগস্ট সকালে শায়েস্তাগঞ্জের নছরতপুরে ট্রাক ও সিএনজি অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে ছয় শ্রমিক নিহত হন। বিষয়টি হবিগঞ্জ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনের মাধ্যমে জানতে পেরে তাৎক্ষণিক জেলা প্রশাসক নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা ও ২০ কেজি করে চাল অনুদান দেন এবং বিনা ময়নাতদন্তে নিহতের লাশ দাফনের ব্যবস্থা করেন।

এরপর শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসক নিহতদের পরিবারকে জনপ্রতি দুই লাখ টাকা করে সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করেন। পরে গত ৯ জুন তাদের নামে বরাদ্দকৃত ওই টাকার চেক মৌলভী বাজারের শ্রীমঙ্গল শ্রম অধিদপ্তর থেকে ইস্যু করা হয়।

বিষয়টি জানতে পেরে ওই দিনই চুনারুঘাটের দালাল চক্রের মূল হোতা মো. আব্দুল্লাহর সহযোগিতায় তার আত্মীয় রমজান মিয়া, নুরুল আমিন ও ফারুক মিয়া চেকগুলো উত্তোলন করে স্থানীয় ইসলামী ব্যাংক নোয়াপাড়া শাখায় জমা করে। এ সময় তারা জন প্রতি দুই লাখ করে ১২ লাখ টাকা টাকা উত্তোলন করে নিহতদের ৬ জনের মধ্যে উপজেলার শ্রী বাউর গ্রামের মোছা. মিনারা খাতুনসহ ৫ স্বজনকে ৬৫ হাজার টাকা করে বুঝিয়ে দিয়ে বাকি টাকা হরিলুট করে। তাৎক্ষণিক বিষয়টি জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনকে অবগত করেন ভুক্তভোগি স্বজনরা।

পরে মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন বিষয়টি জেলা প্রশাসককে অবগত করলে তিনি তাৎক্ষনিক ওই টাকা উদ্ধারে শ্রীমঙ্গল শ্রম অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে তৎপর কার্যক্রম গ্রহণ করেন।

জেলা প্রশাসকের তৎপরতার বিষয়টি জানতে পেরে নড়ে-ছড়ে বসে ওই দালাল সিন্ডিকেট চক্রটি। তড়ি-ঘড়ি করে প্রায় সপ্তাহ খানেক চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবু তাহেরের মাধ্যমে সমঝোতা বৈঠক বসায় দালাল চক্রটি। বৈঠকে মিনারা খাতুনসহ নিহতদের ৪ স্বজনকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে বুঝিয়ে দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রাখে তারা।

তাছাড়া মো. আব্দুর রহিম রাজ নামে নিহতের আরেক স্বজন জালাল উদ্দিনের মাধ্যমে জেলা প্রশাসককে বিষয়টি অবগত করলে তার পিতা ২ লাখ টাকা বুঝে পান। তবে সে দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে সিন্ডিকেট চক্রের মূল হোতা আব্দুল্লাহ তাকে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে এবং বিভিন্ন ভাবে ক্ষয়-ক্ষতি ও হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগি মিনারা খাতুন ও আব্দুর রাহিম রাজ জেলা প্রশাসকের কাছে আত্মসাতকৃত টাকা উদ্ধার ও দালালদের আইনের আওতায় এনে প্রয়োজনীয় শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

ভুক্তভোগি মিনারা খাতুন বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার আমার মেয়ে রাহেলা খাতুন ৫টি শিশু বাচ্চা রেখে মারা গেলে ডিসি স্যার সরকারিভাবে আমাকে ২ লাখ অনুদানের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দালালরা আমাকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে বাকি টাকা আত্মসাত করে। এ বিষয়ে আমি ডিসি স্যারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।

অপর ভুক্তভোগি আব্দুর রাহিম রাজ বলেন, দালাল আমাকে প্রথমে ৬৫ হাজার টাকা দিতে চায়। কিন্তু আমি ওই টাকা না নিয়ে ডিসি স্যারের কাছে যাই। তিনি শ্রম অধিদপ্তরে যোগাযোগ করলে কর্তৃপক্ষ আমাকে সম্পূর্ণ টাকা বুঝিয়ে দেয়। তবে দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি ধামকি দিয়ে আসছে।

এ ব্যাপারে চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু তাহের বলেন, নিহতদের স্বজনদের টাকা পাইয়ে দিতে কয়েকজন শ্রমিক নেতা সহযোগিতা করে বলে দাবি করে। তারা আমার কাছে আসলে আমি নিহতদের স্বজনদের আমার কাছে ডাকি। সপ্তাহখানেক পূর্বে উভয় পক্ষের লোকজন আমার কাছে এলে অনেক আগেই বিষয়টি চেকের মাধ্যমে সমাধান হয়েছে বলে তারা আমাকে জানায়। তবে এ সময় শুধু একজন মহিলা টাকা পায়নি বলে অভিযোগ করেন। এ সময় আমি বিষয়টি সমাধান করার জন্য ভূক্তভোগি ওই মহিলাকে পরামর্শ দিলে তিনি চলে যান।

আপনার মাধ্যমে ৪ জনকে জনপ্রতি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে দিয়ে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে বিষয়টি সমাধান করা হয়েছে বলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কোনো সমাধান করিনি এবং সাদা কাগজে স্বাক্ষর রাখার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তবে আমার জানামতে বিষয়টি চেকের মাধ্যমে আগেই সমাধান করা হয়েছে।

হবিগঞ্জ জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৬ পরিবারকে ডিসি স্যারের মাধ্যমে সর্বাত্তম সহযোগিতা করি। সম্প্রতি শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত সরকারি অনুদানের টাকা একটি দালাল চক্র আত্মসাত করেছে বলে জানতে পেরে ডিসি স্যারকে অবগত করি। তাৎক্ষণিক তিনি হস্তক্ষেপ গ্রহণ করলে চক্রটি কয়েকজনকে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা করে বুঝিয়ে দিয়েছে। বাকি টাকা উদ্ধারে ডিসি স্যার প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন