প্রতি বছরের মতো চলতি বর্ষা মৌসুমেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের চরসোনারামপুরের বিভিন্ন অংশে ভাঙন শুরু হয়েছে। কয়েকদিনে দুটি ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, দেবে গেছে সেখানের শ্মশানের মাটি। এতে চরে বসবাসকারি মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে আতংক। এদিকে চরের অপর পাশের অংশে স্থাপিত আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের রিভারক্রসিং টাওয়ারের স্থানটিও তলিয়ে গেছে পানিতে, ভাঙনের কারণে টাওয়ারের তিন পাশের নদী সীমানা টাওয়ারের কাছাকাছি চলে এসেছে। যে কারণে তলিয়ে যাওয়া স্থানে প্রতিদিনই ভিড়ছে নৌযান। এতে নিরাপত্তাহীনতা ও হুমকিতে রয়েছে জাতীয় জনগুরুত্বপুর্ণ এই স্থাপনাটির।
ইতোমধ্যেই পিজিসিবি‘র (পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি বাংলাদেশ) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক টাওয়ারের এলাকা পরিদর্শন করে একটি দল। পরিদর্শনকালে বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া টাওয়ার এলাকার নিরাপত্তা ব্লক ও জিও ব্যাগ সরে গিয়ে স্থানচুত্যি হয়েছে বলেও জানান তারা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চরের উজানে অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে ড্রেজিং, কতিপয় চরবাসীর নদীতীর দখল, তীব্র স্রোত ও নৌযানের কারণে এই ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধ ও টাওয়ারের নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি) ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা পর্যাপ্ত নয় এমনটি দাবি করেছেন চরবাসী। তারা চর রক্ষায় চারপাশে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিও জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেঘনা নদীর বুকে জেগে উঠা ব্রাহ্মণবাড়িয়া আশুগঞ্জের চরসোনারামপুরের জনবসতি বৃটিশ আমলের। বর্তমানে চরে বসবাসকারি প্রায় সাড়ে ৬ হাজারের (৬৪২২) জনগোষ্ঠির ৯০ ভাগই হিন্দু ধর্মাম্বলী। চরের পূর্ব সীমানায় রয়েছে ২৩০ কেভি আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের রিভারক্রসিং ৩নং টাওয়ার। প্রতিবছর বর্ষা শুরু এবং শেষের দিকে টাওয়ার এলাকায় এবং চরের মধ্যবর্তী শ্বশান ঘাট এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। গত বছর শুকনো মৌসুমে (নভেম্বর-২০২১) চরের শ্মশান ঘাট এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছিল।
চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে আবার ভাঙন শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহে চরের বাসিন্দ রাসু দাস, উৎপল দাসের বাড়ির একটি অংশ নদীতে তলিয়ে এবং সেখানে অবস্থিত শ্মশানের মাঝখানের মাটি দেবে গেছে। তাছাড়া প্রতিদিন চরে বিভিন্ন স্থানে ছোট খাট ভাঙন চলছে। স্থানীয় প্রশাসন ও উপজেলা দুর্যোগ প্রস্তুতি কমিটি চরের ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা নিতে অনুরুধ করে।
এদিকে চলতি বর্ষা মৌসুমের পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় পানিতে তলিয়ে গেছে চরের পুর্ব পাশে অবস্থিত আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের রিভারক্রসিং টাওয়ারের নিচু এলাকা। বর্তমানে টাওয়ারে আশে-পাশের জায়গায় প্রায় ৩ থেকে ৭ ফুট পানি থাকায় বিভিন্ন মালবাহী স্টিলের নৌযান টাওয়ার এলাকায় নোঙর করে নৌকা পরিষ্কারও করছে। শ্রমিকেরা টাওয়ারের নিচে গোসল করছে। নৌকার ধাক্কায় স্টিলের তৈরি টাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
দুই বছর আগে (২০১৯) টাওয়ার এলকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিলে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল। তাছাড়া টাওয়ারের নিরাপত্তায় সিমেন্টের ব্লক রয়েছে। নৌকা নোঙর ও লোকজনের যাতায়তের কারনে পানিতে তলিয়ে যাওয়া টাওয়ারের নিচের ভিজা মাটি ও ব্লক সরে গেলে ব্যাপক ক্ষতির আশংকাও রয়েছে। এসব বিষয় পিজিসিবি‘র নজরে আনা হলে তারা টাওয়ারের নিরাপত্তায় টাওয়ারের আশে-পাশে লোকজনের যাতায়ত, নৌকা নৌকা না করতে সর্তকতা জারি করে এবং বিষয়টি নজরদারি করার জন্য নৌপুলিশকে অবহিত করে। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) টাওয়ার এলাকায় ও চরের শ্মশান ঘাট এলাকায় ৭ হাজার জিও ব্যাগ ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
চরবাসী ইব্রাহিম মোল্যা, ভারত দাস, শিপন দাসসহ বেশ কয়েকজন চরের বাসিন্দা জানায়, কয়েক বছর আগে চরের উজানে মেঘনা নদীতে অপরিকল্পিত ড্রেজিং করার পর থেকে প্রতিবছর চরে ভাঙন শুরু হয়েছে। তাছাড়া চরের কিছু লোকজন নিজেদের বাড়ির পাশে ইট-বালি ফেলে স্রোতের স্বাভাবিক গতি প্রবাহ নষ্ট করায় বিরুপ প্রতিক্রিয়া , নদীতে চলাচলকারি ইঞ্জিন চালিত নৌকার ও বর্ষাকালে তীব্র ঢেউয়ে ভাঙন দেখা দেয়। তাই তারা চর রক্ষায় চরের চার পাশে বেড়ি বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।
এব্যাপারে আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার অরবিন্দ বিশ্বাস বলেন, চরের ভাঙন এলাকা পরির্শন করে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে চরসোনারামপুরে স্থাপিত আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের রিভারক্রসিং টাওয়ারের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছে পিজিসিবি কর্তৃপক্ষ। পিজিসিবি‘র ডিজাইন এন্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল (সিভিল ডিজাইন) বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. গোলাম রব্বানী গত বুধবার সকালে এ পরিদর্শন করেন। এ সময় তার সাথে ছিলেন পিজিসিবি‘র স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারি প্রকৌশলী সাদী মোহাম্মদ।
পরিদর্শনকালে পিজিসিবি‘র ডিজাইন এন্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল (সিভিল ডিজাইন) বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. গোলাম রব্বানী বলেন, সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় টাওয়ারের নিরাপত্তার জন্য যে ব্লক ও জিও ব্যাগ দেয়া ছিল তা কিছুটা নষ্ট ও স্থানচ্যুতি হয়েছে। টাওয়ার এলাকায় ৩ থেকে ৫ ফুট পানি পাওয়া গেছে। এছাড়া টাওয়ারের পশ্চিম পাশে (চরঘেষে) নতুন করে প্রবল স্রোতধারা বইছে-যাতে টাওয়ারের পশ্চিম পাশের মাটি সরে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, সরেজমিনে পাওয়া বিষয়গুলি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।
আনন্দবাজার/শহক