ঢাকা | মঙ্গলবার
১৪ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৩০শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বাস্থ্যসেবা চিকিৎসাখাতে পরিণত হয়েছে

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ এর ক অনুচ্ছেদে চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। এমনকি ১৮ এর ১ অনুচ্ছেদ অনুসারে জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক দায়িত্ব হলেও এখাতে নিজের পকেট থেকে ৬৮ শতাংশ অর্থব্যয় করতে হয়। এ ব্যয়ের বেশির ভাগই ওষুধ, পথ্য ও পরীক্ষা-নীরিক্ষা বাবদ ব্যয় করতে হয়। দেশে স্বাস্থ্যসেবাখাতকে চিকিৎসাখাতে পরিণত হয়েছে। এতে জনগণের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হচ্ছে না।

আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৬ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। এটি জাতীয় বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এটি দিয়েও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা তো নয় বরং চিকিৎসাসেবা দেওয়াও সম্ভব নয়।

২৪ জুন মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস ও দৈনিক আনন্দবাজার আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩: স্বাস্থ্য ও পরিকেশবিষয়ক পর্যালোচনা’য় বক্তারা এসব কথা বলেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, এখন রুগ্ন মেডিকেল কলেজ তৈরি করা হচ্ছে। নার্সিং, ফিজিওথেরাপির জন্য আলাদা কলেজ ইত্যাদি। আমলারা একদিকে থাকে আর বাকিরা একদিকে। দেশে প্রশিক্ষিত ডাক্তার প্রয়োজন। মাত্র ৪ কোটি টাকায় ল্যাবরেটরি করা যায়। আমাদের কাজগুলো আনন্দদায়ক করতে হবে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকদের ট্যাক্স বাতিল করতে হবে। এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দেশের রোগব্যাধী বেড়ে আকাশ ছুঁইছে। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি বাস্তবায়ন না করলে দেশের স্বাস্থ্যসেবাখাত ঠিক হবে না। এজন্য ১. ওষুধের দাম কোম্পানি নয় সরকারকে নির্ধারণ করতে হবে, ২. মেডিকেল ইক্যুপমেন্টের ওপরে ১৬ শতাংশ ভ্যাট ১৮ শতাংশ করা হয়েছে তা কমাতে হবে, ৩.বিল্ডিং মানেই স্বাস্থ্যসেবা নয় ভালো ও প্রশিক্ষিত ডাক্তার তৈরি করতে হবে, ৪. প্রতিটি ইউনিয়নে ৫ জন করে ডাক্তার দিতে হবে ও তাদের সব ব্যয় সরকার বহন করবে।

তিনি বলেন, সরকারকে সামনের দিকে তাকাতে হবে। আগামী ২০ বছর কি হবে তা চিন্তা করতে হবে। তখন মানুষ হবে ২৫ কোটি। সরকারি ভাষ্যমতে ৪ কোটি মানুষের ৬০ বছরের ওপরে। বয়স্ক লোকদের সেবা করাবে কে?
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বর্তমানে বিশ্বে ভ্যাবারেজ ও বিসমার্ক মডেলে স¦াস্থ্যখাত চলছে। ভ্যাবারেজ মডেলটি যুক্তরাজ্যের। এটি জনগণ থেকে সরকার ট্যাক্স নিয়ে জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়। অপরটি বিসমার্ক মডেল। যা জার্মানিতে শুরু হয়। বাংলাদেশে ভ্যাবারেজ মডেলে চলে। আর এখন মূলত বিশ্বে চলে বিসমার্ক মডেলে।

তিনি বলেন, ২০১২ সালের স্বাস্থ্যনীতিমালা যা করা হয়েছে তাতে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যবিষয়ক তেমন কিছু বলা হয়নি। এজন্য যুগোপযুগী একটি নীতিমালা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যবিমা বলতে সাধারণত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সব জনগণের জন্য চলবে। সরকারি চাকরিজীবী ১৩ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে প্রিমিয়াম বেতন থেকে নেয়া ও ৮৭ শতাংশ জনগণের অর্থ সরকার দিবে। তহবিল সমস্যার সমাধান হচ্ছে- সাড়ে ১৮ হাজার কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ১০ টাকা করে নিয়ে আর সরকার কিছু দিলে ১০ হাজার কোটি টাকা আসবে। হেলথ ইকুইটি ফান্ড করা যেতে পারে। সমাজকল্যাণ ফান্ডও ব্যবহার করা সম্ভব।

তিনি বলেন, সব জায়গায় স্বাস্থ্যকর্মী থাকতে হবে। কেননা সরকার স্বাস্থ্যখাতে ফাইনান্সিয়াল অটনমি নিতে চায় না। সরকারি হাসপাতালে নিয়ম পরিবর্তন না হলে স্বাস্থ্যবিমা সম্ভব নয়।

অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্যসেবাখাতে সরকারি ব্যয় করছে ৩০ হাজার কোটি টাকা হলেও বেসরকারিভাবে নিজ পকেট থেকে তিন গুণ একশ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। তিনভাগে করা হয় ২০১২ সালের স্বাস্থ্যসেবায় অর্থনীতির বিভাজন। ১. দারিদ্র, ২. ফরমাল সেক্টরে কর্মরত ও ৩. ইন-ফরমাল সেক্টরে কর্মরতদের।

স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে হলে সমস্যা হচ্ছে দেশের ৮৭ শতাংশ মানুষ ইন-ফরমালে কর্মরত। ১. তাদের প্রিমিয়ামের টাকাগুলো সরকারকে দিয়ে দিতে পারে। ২. মোবাইল ফোন থেকে মাসে ১০ টাকা কেটে নেয়া যায়। তাতে দুই হতে আড়াই হাজার কোটি টাকা হয়। ৩. সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন থেকে প্রতি মাসে কেটে নেয়া।

স্বাস্থ্যসেবাদানকারী কারা হবে: স্বাস্থ্যবিমা থাকলে সর্বস্তরে স্বাস্থ্যকর্মী থাকতে হবে। এ জন্য সরকারের সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালকেও ফিনান্সিয়াল অটনমি দিতে হবে। সেখানে বেশি খরচের রোগ যেমন, ক্যান্সার, কিডনি ডায়ালাইসিস, সিওপিডিসহ এ ধরনের ৭-১০টি বড় রোগ, এক্সিডেন্টের রোগীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা আপাতত চালু করা যেতে পারে। তাদের জন্য মোবাইল ফোন থেকে ১০ টাকা প্রিমিয়াম চালু করা। সেখানে সরকার কিছু দিবে তাতে ৫ হাজার কোটি টাকার ফান্ড করা হবে। তাতে প্রত্যেকের জন্য ৫ লাখ টাকা করে দেয়া যায়। অন্যদিকে হেলথ ইক্যুটি ফান্ড করা যেতে পারে। সেখানে ১. সরকার অর্থ দেবে, ২. দাতা সংস্থা, ৩. কোয়ান্টাম সংগঠন, ৪. ওষুধ কোম্পানির সিএসআর থেকে ফান্ড আসবে, ৫. প্রবাসীরা দিতে পারে ও ৬. সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় টাকা দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা এগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে আনতে হবে।

হেলথ এন্ড হোপ স্পেশালাইজড হাতপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যসেবাকে চিকিৎসাতে পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা মূলত রোগের হয়। আর স্বাস্থ্যসেবা মূলত পুরো জাতির সুস্থ্য মানবিক বিকাশ। বেসরকারি হাসপাতালে ৬০-৬৫ শতাংশ মানুষ সেবা নেয় কিন্তু তাদের জন্য বাজেটে কিছুই নেই। সরকারি-বেসরকারি হাসপতালের অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। একে বিকশিত করতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটটি হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা, সামান্য ওষুধপাতি দিয়ে চালিয়ে নিতে। অথচ ৮০-৮৩ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে থেকে করা হয়। অর্থাৎ সরকার ইচ্ছা করেই বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাষ্ট্রের বাজেটটি জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা বাজেট করতে হবে।

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যসেবাখাত জাতীয়করণ করতে হলে সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। অর্থনৈতিক বিভাজন সুস্পষ্ট হতে হবে। বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতে পর্যবেক্ষণ, তদারকি ও জীবনবান্ধন বিকার তা সরকারকে দেখভাল করতে হবে। যেমন ১. চিকিৎসকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাখাত মূলত ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে শুরু হলেও একে নিয়ন্ত্রণ, বিকাশ ও দিকনির্দেশনা দেয়ার মত কোন নীতিমালা নেই।

তিনি বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যমিবা নিশ্চিতে সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১. তামাকজাত পণ্য আমদানি-রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায়, ২. স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সিএসআরের ৫০ শতাংশ, ৩. মোবাইল থেকে অর্থ কেটে নেয়া, ৪. স্বাস্থ্যভ্যাট যুক্ত করা, ৫. জমি বিক্রি থেকে দশমিক শুন্য ১ শতাংশ কর নিলে এসব ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা যুক্ত করে সার্বজননীয় স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা যায়। স্বাস্থ্যখাতে জাতীয় বাজেটের ৬ ও জিডিপির ১ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে। এই বাজেট দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অসম্ভব।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, পরিবেশ ভালো হয়ে গেলে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় কম হবে। কেননা পরিবেশগত রোগবালাই বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা পানি, বায়ু, খাদ্য, বর্জ্যব্যবস্থাপনাতে হুমকির মুখে পড়েছি। এ সমস্যা সমাধানে বর্তমান বাজেট অপ্রতুল বরং আরো কয়েকগুণ বাজেট প্রয়োজন পরিবেশখাতে।

বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল হাসান সোহেল বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সচিব ও অন্যান্য নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে ডাক্তারদের থেকে নিয়োগ দেয়া দরকার। আর ব্যয়ের দিকে সঠিক পরিকল্পনাও দেখা যায় না।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন