- ঢাকার মশা নিধনে মেয়রের চার প্রস্তাব
- রোহিঙ্গা ক্যাম্প এডিস মশার হটস্পট: ডা. নাজমুল ইসলাম
লাইটিং পলিউশনের কারণে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার চরিত্র পাল্টে গেছে। আগে যদিও দিনে কামড়াতো এখন রাতেও কামড়ায়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ‘ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক ঢাকা ইউটিলিটি রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন-ডুরা সংলাপে এ কথা জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার।
গতকাল বুধবার বিকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনায় মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপনালে তিনি এ কথা বলেন। ডুরার সভাপতি রুহুল আমিনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। ডুরার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জয়শ্র ভাদুড়ীর সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট-আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মোহাম্মদ খান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম।
শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ঢাকা শহরকে বিশ্রাম দেয়া শুরু হয়েছে। এখন বায়ুমানও ভালো হচ্ছে। এটি অর্থনীতির সূচকেও ভালো করবে। মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আগে ভঙ্গুর ছিল। বেড়ে গেলে পদক্ষেপ নেয়া হতো। এটিকে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা ছিল না। প্রতিটি দেশেই সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নেয়া হয় বছরব্যাপী। আমরা দায়িত্ব নিয়ে সে কাজ শুরু করেছি।
মেয়র বলেন, মশার বিনাশ করতে ৪টি কাজ করতে হয়। তার মধ্যে ১. উৎস ধ্বংস, ২. রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা, ৩. জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও ৪. ওয়ার্কার ম্যানেজমেন্ট করা। এই চারটি কাজ করলে মশা ধ্বংস করা সম্ভব। ঢাকায় দু’প্রকার মশা ১. কিউরেস, এটি বেশি কামড়ালেও মৃত্যু হয় না। ২. এডিস, এটির কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বলে আমরা বেশি গুরুত্ব দেই। এডিস ২০০০ সালে ঢাকায় শুরু হয়। এটির নির্মূলের ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। এক বছর ডিমগুলো অক্ষত থাকে ও পানি পেলে লার্ভা হয়ে ধীরে ধীরে মশায় পরিণত হয়। তিনি বলেন, সকালে ৮ জন লার্ভা ও বিকালে ৫ জন কিউরিকের জন্ম ধ্বংস করবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ জন্য উৎসেই ধ্বংসের ব্যবস্থা নেয়া হয়। ৭৫টি ওয়ার্ডে ১৪ জন করে ১০৫০ জনবল নিয়োগ করা হয়েছে।
কীটনাশকের মজুদ সম্পর্কে মেয়র বলেন, আগে মজুদের ব্যবস্থা ছিল না। এক বছরের পূর্ণাঙ্গ মজুদ প্রয়োজন তা সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। ২০১৯ সাল থেকে সরকার সিটি করপোরেশনকে কীটনাশক কিনতে অনুমতি দেয়। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত কীটনাশক মজুদ রয়েছে। ২০২০ সালের ৭ জুন এই কার্যক্রম শুরু করা হয়।
মেয়র তাপস বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে মশার জন্ম বেশি। জীববৈচিত্র্যের মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ শূন্যের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব। যেমন তেলাপিয়া মাছ মশা খায়, কদমগাছে ফিঙে পাখি এসে কীটপতঙ্গ খায়। হাঁস দিয়ে মশা নির্মূল করা হচ্ছে। সে পানি পরিষ্কার রাখে। ২০১৯ সালে তীব্র আকার ধারণ করলেও ২০২০ সালে কমে যায়। একুশে বেড়ে যায়। জলবায়ুর প্রভাবে এডিসের বিস্তারের আশঙ্কা রয়েছে। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। শরৎ না এসে বর্ষা মৌসুম বিলম্ব হয়েছে। বৃষ্টি হলে এডিসের বিস্তার হবে।
মেয়র বলেন, জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতা না থাকলে এডিস মশার নিধন সম্ভব নয়। এজন্য ঢাকাবাসীর প্রথম করণীয় পানি জমতে না দিয়ে ফেলে দিতে হবে। প্রতিদিন জমা পানি ফেলে দিতে হবে। দ্বিতীয় করণীয় হচ্ছে তথ্য দিতে হবে। তথ্য পেলে সেখানে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়। আমরা সঠিক তথ্য সবসময় পাই না। কীটনাশক ও ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করলে ১৫ দিন এডিসের কোন জন্ম হবে না।
মেয়র বলেন, ২০২১ সালে ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মানুষের সচেতনতার চেয়ে সয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। জরিমানা কাজে আসছে না। মশকবাহিনীর লোকদের নাজেহাল ও অপমান করা হয়। এসব বিষয় আমাদের ক্ষতবিক্ষত করে।
মেয়র বলেন, সবাইকে সম্মিলতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা সব সরঞ্জামাদি নিয়ে কাজ করবো। ঢাকাবাসীকে সুফল দিতে চাই কিন্তু সকলের সহযোগিতা না পেলে আমরা কাজ করতে পারবো না। কেননা আমরা ব্যর্থতার গ্লানি নিতে চাই না।
ড. কবিরুল বাশার বলেন, ব্রাজিলে আক্রান্ত ১১ লাখ ১৪ হাজার ৭৫৪ ও বাংলাদেশে ৬৯৭ জন। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পদক্ষেপ নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বহুতল বিল্ডিংয়ের ফ্লাডেড ফ্লোরে ২৭.৭৮, প্লাস্টিক ড্রাম ১২.৯৬, প্লাস্টিক বক্স ২০.৩৭, পানির ট্যাংকি ৫.৫৬ ও ফুলের টব ও গাছে ৭.৪১। পানি নিরবচ্ছিন্ন থাকলে এডিস মশা হতো না। এটি শুধু দিনে নয় রাতেও কামড়ায়। তিনি বলেন, লাইট পলিউশনের কারণে এডিসের চরিত্র পাল্টে গেছে। থেমে থেমে বৃষ্টি হলে এডিসের মাত্রা বেড়ে যায়। মশা মারার বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ নেই। কীটনাশকে এডিস নিয়ন্ত্রণ করা যায় না বরং পরিবেশগত পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একক দেশে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দিয়েছে। সিঙ্গাপুর ও ঢাকার সম্প্রসারণ সম্পূর্ণ আলাদা।
ড. কবিরুল বাশার আরও বলেন, এডিস নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং ও ইভালোয়েশন থাকতে হবে। থাকবে স্বাস্থ্যশিক্ষা। এডিস সমূলে ধ্বংস করতে চাইলে পানিতেই বিনাশ করতে হবে। উদ্ভিদ ও ফলের রস খেয়ে জীবন বাঁচালেও পেটে ডিম আসলে মানুষের বা অন্যান্য প্রাণীর রক্ত খায় মশা।
ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প এডিস মশার হট স্পট পরিণত হয়েছে। ১৯৬০ এর দশকে এডিস বাহিত রোগ বা ঢাকা ফ্লিভার নামে চিহ্নিত করা হয়। দীর্ঘদিন জ¦রসহ বিভিন্ন রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি বিনাশে জনসম্পৃক্ততা ও জন সচেতনতা প্রয়োজন।
ড. আদিল মোহাম্মদ খান, মহামারির কারণ মূলত নগরায়ন সমস্যার ফলে। এসির কারণে ডেঙ্গু হচ্ছে সিঙ্গাপুরে। এ জন্য প্রয়োজন মুক্ত বাতাস ও এলাকা। বর্জ্যব্যবস্থা ঠিক না হলে মশার জন্ম হবেই। কালভার্টে ডেঙ্গুর লার্ভার জন্ম। নগরের বিল্ডিং কোড, ভলিয়ম, পরিকল্পিত নগরায়ন প্রয়োজন। জলাশয়গুলো পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
তিনি বলেন, নগরে ৭০-৮০ শতাংশ শিল্পায়ন হচ্ছে আবাসিক এলাকায়। এটি হলে বাঁচা সম্ভব নয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মকর্তা ফজলে কাউসার জানান, আমরা ১০৫০ জনবল নিয়ে কাজ করছি। ছাদবাগান মশার জন্মের উৎস হিসেবে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৩টি ঝুকিপূর্ণ ও ৪টি কম ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড ঘোষণা করলে সেখানে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিতাস, রেলওয়ে ও ওয়াসার বিভিন্নস্থানে মশার লার্ভার জন্মের আদর্শ জায়গা।
আনন্দবাজার/শহক