মেঘনা পাড়ের মাঝি আমি,/ মেঘনা পাড়ে বাড়ি/ সকাল সাঁঝে নৌকা আমার/ যাচ্ছে দুকূল ছাড়ি- কবিতার মতোই চিত্র এখন মেঘনা পাড়ে। তবে মাঝি নয়, হাজারো শিশু এখন নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যায়। পরিবারের অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে দ্বীপ জেলা ভোলার চরফ্যাশনে নৌকা আর জাল হাতে তুলে নিয়েছে তিন হাজার শিশু। পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই মাছ ধরছে মেঘনা ও তেতুলীয়া নদীর উপকূলবর্তী এলাকার এসব শিশু।
পড়াশোনার সুযোগ বঞ্চিত হয়ে তারা পৈত্রিক জেলে পেশার সহযোগী হচ্ছে। তবে, জেলে পেশায় জড়িয়ে যাওয়া শিশুদের স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করে এদের উপবৃত্তির আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন সমাজসেবা অফিসার।
উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্য মতে, চরফ্যাশন উপজেলার তিন হাজার শিশু জেলে পেশায় নিয়োজিত। এসব শিশুর বয়স ৭ থেকে ১৪ বছর। এসব শিশু ছাড়া উপজেলায় প্রায় ৯০ হাজার জেলে রয়েছে। নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৪ হাজার ২শ’ ৮১ জন। অনিবন্ধিত জেলে রয়েছে প্রায় ৪৬ হাজার। এসব জেলে নদী ও সাগরে মাছ শিকার করে। এ অঞ্চলে প্রায় ১২ হাজার ট্রলার ও নৌকা রয়েছে। এছাড়াও গভীর সমুদ্রগামী ৭ হাজার ট্রলার রয়েছে।
মেঘনা নদীতে মাছ ধরেন সাইফুল (১১) ও ইব্রাহিম (১৪)। তারা চরফ্যাশন উপজেলার আসলামপুর এলাকার কালাম মাঝির ছেলে। বাবা কালাম মাঝির সঙ্গে মাছ ধরতে যায় নদীতে। কোনো কোনো সময় বাবার অনুপস্থিতিতে তারা নৌকার বৈঠা ধরেন।
তাদের বাবা কালাম মাঝি (৫৬) জানান, আমার পরিবারে ছয়জন মানুষ। একজনের রোজগারে পোষায় না। নদীতে জাল ফেলা, মাছ ধরা, ঘাটে বেচাসহ এত কাজ একা করা সম্ভব হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে দুই ছেলেকে নিজের সঙ্গে কাজে নিয়ে যাই।
এদের মতো জেলে পরিবারের শিশুরা ব্যস্ত সময় কাটায় নদীতে। জেলে নৌকায় বড়দের সঙ্গে শ্রম দিচ্ছে এমন শিশুর বয়স সাত-চৌদ্দ বছর। তারা এ বয়সেই পরিণত হয় একজন দক্ষ মাঝি বা জেলে রূপে। দারিদ্রের কারণে উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ এ পেশায় যুক্ত হচ্ছে।
সামরাজ মৎস্যঘাট এলাকার জেলে কাদির (৪৫), কামরুল (৩২), জালাল মাঝি (৪২) বলেন, ‘আমরা বাপদাদার পেশায় থেকেই মাছ ধরে আয় রোজগার করছি। আমাদের ছেলেদেরও এই কাজই করতে হবে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ আমরা। মাছ না পেলে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। নদীতে না গেলে তো জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। লেখাপড়ার করানোর সামর্থ্য নেই।’
চর মাদ্রাজ এলাকার ট্রলার মালিক লোকমান হোসেন বলেন, সংসারের অভাবের তাড়নায় শিশুরা নৌকা ও ট্রলারে কাজ করে। এসব শিশু বাবুর্চির সহকারী, জাল টানা ও জাল থেকে মাছ বাছাই করাসহ মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে কাজ করে থাকে।
চরফ্যাশন সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আশ্রাফ হোসেন জানান, ‘সরকারের পক্ষ থেকে উপবৃত্তির টাকা, বিনামূল্যের বই ওদের জন্যও বরাদ্দ থাকে। এসব অনুদান নিয়েও পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে কাজে নামে শিশুরা। স্কুলের হাজিরা খাতায় নাম থাকলেও দিন কাটে নদীর বুকে। এসব শিশুর স্কুলমুখি করতে খুব শিগগিরই স্কুলের পাঠদানের চলমান সময়সূচি পরিবর্তন আসতে পারে। পৌরসভাসহ উপজেলার ২১টি ইউনিয়নে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ৬২ হাজার ৮০৬ জন। এসব শিক্ষার্থীর ৩০-৪০ শতাংশ উপকূলীয় এলাকার।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মারুফ হোসেন মিনার জানান, দারিদ্রর কষাঘাত ওদের জেলে পেশায় যেতে বাধ্য করেছে। অনেকেরই স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হয় না। চরফ্যাসন উপজেলায় শিশু জেলের সংখ্যা প্রায় তিন হাজারের মতো। এ পেশায় শিশুদের যুক্ত না করতে অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মামুন হোসেন জানান, বাবা-মায়ের অসচেতনতার কারনে এসব শিশুর ভবিষ্যত নষ্ট হচ্ছে। শিশু জেলেদের স্কুল ভর্তি নিশ্চিত করা গেলে এদের উপবৃত্তির আওতায় আনা হবে। তাছাড়া এতিম শিশুদের জন্য চরফ্যাশনে এতিমখানা ও ভোলাতে দুটি শিশু পরিবার (বালক-বালিকা) রয়েছে। সেখানে ১৮ বছর পর্যন্ত এদের ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকার নিয়েছে।
আনন্দবাজার/শহক




