বিশ্বের ১৭টি দেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে এনে বৈধ উপায়ে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। বৈধভাবে যারা কর দেন কোনোক্রমেই তাদের সম্মানে আঘাত আসবে না। কেননা ভালো মানুষ সব সময় ভালো কাজই করে থাকে। এক্ষেত্রে যাতে ভবিষ্যতে কেউ অর্থ পাচার করতে না পারে সেই সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বাজেটোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ কথা বলেন। রাজধানী ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিকাল তিনটায় সাংবাদিক সম্মেলনটির আয়োজন করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ বিভাগের সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার ও কানিজ ফাতেমা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
সূচনা বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়গুলোকে প্রাধিকার দেয়া বাজেটের বিশেষ দিক। কোভিডেও আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি ঠিক ছিল।
বাজেটের প্রত্যাশা হচ্ছে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া। প্রস্তাবিত বাজেটে আপামর জনসাধারণ উপকৃত হবে। আমাদের মূল শক্তি মানুষের প্রাণশক্তি। পৃথিবীর অর্থনীতি যেখানে ভঙ্গুর তা উন্নয়নে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। যাদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই সে প্রকৃত মুসলমান নয়। তাই দেশের উন্নয়নে সবাইকে মেধা ও শ্রম নিয়োগ করতে হবে। তিনি নিজের পরিবারের দারিদ্রতা নিয়ে বলেন, গরিব হওয়া খুব কষ্টের। আমি নিজেও গরিব ছিলাম। এখান থেকে মুক্তি পেতে চাইলে সবাইকে মিলে কাজ করতে হবে।
রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জন সম্ভব প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, লক্ষ্যমাত্রা সব সময় অর্জিত হয় না। কিন্তু নেয়ার সময় বেশি নিতে হয়। মানি লন্ডারিংয়ের টাকা ফিরে আসবে প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ট্রুথ কমিটির কাজটি আইনগত ছিল না। এখন যেটি নেয়া হয়েছে তা সংসদে আইন করে নেয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, অনেক দেশ এই কাজ করেছে। ইন্দোনেশিয়া ৯.৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশ থেকে ফেরত নিয়ে আসে। আমরাও সেই কাজ করবো। সব টাকাই কালো না। অনেক সময় নানাভাবে টাকাকে কালো করতে বাধ্য হয় মানুষ। আমরা সেই সুযোগটা বন্ধ করতে চাই। ইতিপূর্বে দুই বছর যে সুযোগ দেয়া হয়েছিল তা ছিল দেশের এনবিআর।
কালো টাকা সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা কালো টাকার পরিবর্তে অপ্রদর্শিত টাকা বলি। সব সময় সঠিক তথ্য দেয়া হয় না। টাকা পাচার সম্পর্কে কি ইন্টিলিজেন্সগ্রুপ জানে না প্রশ্নের জবাবে বলেন, সুদ ও বিলাস যেখানে টাকা সেখানে চলে যায়। সুটকেসে পাচার করে না। নানান টুলস ব্যবহার করে পাচার করে। ফিনল্যান্ড, নরওয়ে টাকা পাচার ঠেকাতে ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। পাচার টাকা এ দেশের মানুষের হক। এসব আনতে বাধা দিবেন না। ১৭টি দেশ ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে অর্থ ফেরত এনেছে। এতে টেক্স দেয়াদের সম্মান কমে না। মহানবী সা. এর হাদিস উল্লেখ করে বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, ঘুষ দেয়া ও নেয়া উভয়ই জাহান্নামি। আমরা মানুষের ভালোবাসার জন্য কাজ করি। ঘুষ বন্ধ করতে কাজ করছি। ল্যাপটপ ও মোবাইলে কর বৃদ্ধি সম্পর্কে বলা হয়, দেশিয় পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মেড ইন বাংলাদেশকে সামনে তুলে ধরতেই এটি করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, উৎপাদন বাড়াতে কৃষিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। খাবারের পরিমাণ কমানো হয়নি। গত বাজেট জিডিপির ১৭ শতাংশ থাকলেও এবার ১৫ শতাংশ করা হয়েছে বাজেট। কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় জুলাই থেকে বাদ দেয়া হবে। জ্বালানিতে ভর্তুকি সম্পর্কে বলেন, ৬৫ কোটি টাকা লস দিচ্ছে বিপিসি। সার, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য খাতে ভর্তুকি বাদ দিলে ৫/৬ শতাংশ ব্যয় বেড়ে যাবে। কৃষিতে বরাদ্দ গতবছরের চেয়ে বেশি দেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, বর্ধিত চাহিদা যাতে না আসে সে জন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। ২৩৩ শতাংশ দাম বেড়েছে গ্যাসে। সেখানে কিছু টাকা বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির উপকরণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, চিকন চালের দাম বেড়েছে। এটি ৭০ টাকা আর মোটা চাল ৪০ টাকা কেজি। পটাসিয়াম সারে ৩৫০ ডলার প্রতি টনে ভর্তুকি দিতে হয়। ২৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। না দিলে কৃষিকে সংকট দেখা দিত। উৎপাদিত যা হয় তাতে হাহাকার হবে না। বিজ্ঞানীরা এমন কিছু জাত উদ্ভাবন করেছে। প্রতিবছর ২৫ লাখ নতুন মুখ আসে। পুষ্টিকর খাবারে ভাতের ওপর চাপ কমবে। আগে ৪১৭ গ্রাম চাল খেত এখন ৩৭০ গ্রাম হয়েছে। খাদ্যের ক্রাইসিস হচ্ছে, দাম বাড়ছে। হ্যাঁচারির দাম বাড়ছে। অনেক পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। বড় বড় করপোরেট কোম্পানি তামাক ছেড়ে চাল প্যাকেট করছে। শহরের সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট হচ্ছে এ কথা স্বীকার করছি। ভারত সরকার জানিয়েছে, পি কে হালদার ও তার টাকা ফেরত দেবে, বলেন অর্থমন্ত্রী।
সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ কমিয়েছেন কেন প্রশ্নের জবাবে অর্থসচিব বলেন, টাকার অঙ্কে বাড়ছে। সাড়ে ৫ লাখ ওএমএসে চাল বিক্রি হয়েছে দুই বছরে। খাদ্যপণ্যের ৩০ শতাংশ দাম বেড়েছে বিশ্বে। আন্তর্জাতিক পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। বাজার অস্থিরতা থাকবে না, ব্যবস্থা নেয়া হবে।
৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতিকে চ্যালেঞ্জ কেন প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাজেটটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সহায়ক বাজেট। সবাইকে উপকৃত করতেই বাজেট। গত তিন বছর ঠকেননি। আগামীতেও ঠকবেন না। প্রত্যেক গরিবকে নিয়ে বাজেট। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত। কোভিডের ভয়ভীতি মানুষকে দেখায়নি। আমরা এগিয়ে যাবো।
আমাদের ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বেড়ে গেছে। রেমিটেন্সে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ায় ১৪ হতে ২৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে উদ্যোক্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা প্রশ্নের জবাবে অর্থসচিব বলেন, এতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। অলস অর্থ সচল করতে ব্যাংকগুলো ব্যবস্থা নিবে। কৃষিমন্ত্রী বলেন, সরকারের লক্ষ্যই হচ্ছে দারিদ্র কমিয়ে আনা। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। অর্থের কোনো সমস্যা হবে না।
অর্থমন্ত্রী বলেন, রেমিটেন্সের রিজার্ভ ৭ বিলিয়ন ডলার ছিল আওয়ামী লীগ দায়িত্ব নেয়ার সময়, এখন ৪৫ বিলিয়ন ডলার। সংকট ও যুদ্ধ না হলে ৫০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যেত। আমাদের দেশে জিডিপির তুলনায় ঋণ পৃথিবীর সবচেয়ে কম।
বাজেটের সবচেয়ে বড় চাহিদা মানুষের সুযোগ-সুবিধাকে প্রাধিকার দেয়া। ভালো কাজগুলো মূল্যায়ন করুন। তা না হলে আমরা কষ্ট পাই। কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের দ্বিতীয় মূল লক্ষ্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বলেন, আমেরিকায় ৪০ বছরে সর্বোচ্ছ, যুক্তরাজ্যে ৩০ বছরে সর্বোচ্চ। বাইরে যেসবের দাম বাড়ে সেখানে আমাদের কিছু করার নেই।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য ও সকল বিভাগ মিলে ৪০ হাজার কোটি টাকা ৫.৫ শতাংশ এটি ভালো। স্বাস্থ্যসেবা আরো মজবুত হোক আমরা চাইবো। স্বাস্থ্যের কাঁচামালে ডিউটি কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বাজেট সত্যিকারেই জনকল্যাণমূলক। শিক্ষা প্রায় ২০ ভাগ বেড়েছে। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে ২৮টি মন্ত্রণালয় কাজ করে সেখানে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে নতুন এমপিওভুক্তির ঘোষণা আসবে। সঞ্চয়পত্রের সুদ সম্পর্কে অর্থসচিব বলেন, সঞ্চয়পত্রে ৪৫ কোটি টাকা সুদ দিতে হয়। সেখান থেকে ঋণ নিলে কোন সমস্যা হবে না।
আনন্দবাজার/শহক