পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনামলে পূর্ব বাংলায় যত রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণীত হয়েছে ৬ দফা ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সকল আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ৬ দফা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নিপীড়ন এবং শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে ৬ দফা দাবি ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ বঞ্চনা থেকে বাঙালির মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ৬ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন রাস্তায় নেমে আসে লাখো লাখো মানুষ। হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় নিহত হয় অন্তত ১১ জন। তাঁদের স্মরণে এবং জাতীয় মুক্তির স্বারকস্বরূপ ছয় দফা দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। ছয় দফা রচিত হয় লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী।
ছয়দফা দাবি মোট তিনবার ঘোষণা করা হয়। প্রথম ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬, দ্বিতীয় বার- ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬, তৃতীয় বার ২৩ মার্চ ১৯৬৬ লাহোরে (আনুষ্ঠানিকভাবে)। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি লাহোরের উপস্থাপন করেন। এ সময়ে লাহোরের বিরোধীদলগুলোর এক অধিবেশন বসেছিল। এ অধিবেশনে দলের সভাপতি হিসেবে তিনি ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন। পরের দিন ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বিবরণী ছাপা হয়। পর্যালাচনা করলে দেখা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর প্রস্তাবের পূর্ব পর্যন্ত তার নিজ দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এ দাবিগুলা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। বিষয়টি উত্থাপনের পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির অনুমোদন নেন নি। এর ফলে অনেক নেতা কর্মী ক্ষুব্ধ হন এবং অনেকে বিভ্রান্ত হন।
কিন্তু ছাত্রলীগের তরুণ কর্মীরা বাঙালির দাবি ৬ দফা, বাঁচার দাবি ৬ দফা, ৬ দফার ভেতরেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিহিত ইত্যাদি স্লোগান সম্বলিত পোস্টারে দেয়াল ভরে তোলে। শেখ মুজিবুর রহমান লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে এসে ১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে ৬ দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেন। ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ ও মর্নিং নিউজ এ ৬ দফা ব্যাখ্যাসহ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির কোনো সভা অনুষ্ঠানের পূর্বেই আওয়ামী লীগের ৫১ পুরানা পল্টনের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ও আবদুল মমিন কর্তৃক প্রচারিত শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি সংক্রান্ত এক পুস্তিকা বিলি করা হয়। উক্ত পুস্তিকায় ৬ দফার অন্তর্ভুক্ত দাবিগুলা ছিল –
প্রথম দফা : ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহার প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনাপূর্বক পাকিস্তানকে সত্যিকার অর্থে যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে হবে। এতে সরকার ব্যবস্থা হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলো হবে সার্বভৌম।
দ্বিতীয় দফা : যুক্তরাষ্ট্ৰীয় (কেন্দ্রীয়) সরকারের হাতে কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র এ দুটি বিষয় থাকবে, অবশিষ্ট সকল বিষয় প্রদেশসমূহের হাতে থাকবে।
তৃতীয় দফা : এ দফায় মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব ছিল এবং এদের মধ্যে যে কোনো একটি গ্রহণের দাবি করা হয়। যথা :
ক. পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রার লেনদেন হিসাব রাখার জন্য দু’অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে এবং মুদ্রা ও ব্যাংক পরিচালনার ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে, অথবা
খ. পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা থাকবে কেন্দ্রের হাতে। তবে শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে এক অঞ্চল থেকে মুদ্রা অন্য অঞ্চলে পাচার হতে না পারে। এ ব্যবস্থায় পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুঅঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
চতুর্থ দফা : সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ও কর ধার্য এবং আদায়ের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারে হাতে থাকবে। আঞ্চলিক সরকারে আদায়কৃত অর্থের একটি নির্ধারিত অংশ সংগে সংগে ফেডারেল তহবিলে জমা হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাংক সমূহের ওপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসন্তন্ত্রে থাকবে। এভাবে জমাকৃত অর্থ দিয়েই ফেডারেল সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
পঞ্চম দফা: এই দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিম্নরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হয়।
ক. দুঅঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখতে হবে।
খ. পুর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্থানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্থানের এখতিয়ারে থাকবে।
গ. ফেডারেশনের (কেন্দ্রের) জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুঅঞ্চল থেকে সমানভাবে অথবা শসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারে আদায় হবে।
ঘ. দেশজাত দ্রব্যাদি বিনাশুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি করা চলবে।
ঙ. ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সাথে চুক্তি সম্পাদন, বিদেশে ট্রেডমিশন স্থাপন এবং আমদানি-রপ্তানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করতে হবে।
ষষ্ঠ দফা: আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে প্রদেশগুলোকে নিজস্ব কর্তৃত্বাধীনে প্যারামিলিশিয়া বা আধা সামরিকবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে।
পাকিস্তান ঔপনিবেশিক শাসনামলে পূর্ব বাংলায় যত রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণীত হয়েছে ৬ দফা ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সকল আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ৬ দফা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নিপীড়ন এবং শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে ৬ দফা দাবি ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। কারণ পরবর্তীকালে ৬ দফার ওপর ভিত্তি করে বাঙালি জাতি তাদের স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়। ৬ দফাকে কেন্দ্র করে মূলত বাঙালিদের মধ্যে একটি নবজাগরণের সৃষ্টি যা বাঙালির মুক্তির জন্য একান্ত অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে বাঙালির জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ৬ দফা বাংলার কৃষক, শ্রমিক, মজুর, মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ এবং বাংলার স্বাধীনতার গ্যারান্টি।
৬ দফা দাবি ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পশ্চিমাগোষ্ঠী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। কারণ এর পূর্বে বাঙালি জাতির কোনো নেতা এমন সুসংগঠিত দাবি বাঙালির জাতির সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন নি। ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুদৃঢ় ঘটেছিল। এ আন্দোলনের সময় সমগ্র বাঙালি জাতি একটি প্লাটফর্মের অধীনে চলে আসে। ৬ দফা দাবি ছিল বাঙালি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার এক মূর্ত প্রতীক এবং এ কারণেই এর প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল।
৬ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বাঙালি জাতি ১৯৬৯ এ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৬ দফা দাবির মাধ্যমে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানকে একটি পৃথক অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পেশ করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচারণার ফলে ৬ দফার দাবি অতি শিগগিরই বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালিরা স্বাধিকার আন্দোলন পরিচালনা করে। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম দিকে এ আন্দোলন তেমন পূর্ণতা পায় নি। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ৬ দফা দাবি বাঙালি জাতিকে তাদের স্বাধিকার আদায়ের অপরিসীম শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৬ দফার প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচিকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সন্নিবেশ করে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ তথা শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনে জয়লাভ করলে জনগণকে ৬ দফা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। ৬ দফাকে কেন্দ্র করে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের দাবি শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ৬ দফা আন্দোলন ছিল একটি গণমুখি আন্দোলন। যা আদায়ের জন্য বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়নের ফলে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক জীবনে একটি বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। কারণ ৬ দফা প্রণয়নে যিনি একক ভূমিকা পালন করেন তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। অনেকে এটাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ম্যাগনাকার্টা বলে অভিহিত করেছেন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
আনন্দবাজার/শহক