আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস————-
পরিবেশ সংশ্লিষ্ট টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অধিদপ্তর বা সংস্থা নিজেদের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান সরকার পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কার্যকরভাবে মোকাবেলায় বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং সেগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদানপূর্বক বাংলাদেশের সংবিধানে পরিবেশ বিষয়ে একটি পৃথক অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সুস্থ পরিবেশকে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
বিশ্বজুড়ে পরিবেশ দূষণ রোধ ও পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছরের মতো এবারও ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসাবে পালন হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও দিবসটি পালন করছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত মান উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগ আর জনসচেতনতার লক্ষ্যে পালন করা হয় দিবসটি। প্রতি বছরই এ দিবসটি আলাদা প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হয়ে আসছে।
প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে গভীর উদ্বিগ্ন সারা বিশ্ব। ১৯৬৮ সালের ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সুইডেন সরকার। সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরের বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ জুন থেকে ১৬ জুন, জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের ‘প্রথম পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন’-এর স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এরপরে ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল বার্ডেন ডিজিজ প্রজেক্টের প্রতিবেদনে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বায়ুদূষণকে চার নম্বরে দেখানো হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর ৫৫ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকরী পদক্ষেপ ও জনসচেতনতা না বাড়ালে ভবিষ্যতে ভয়াবহ বায়ুদূষণে পড়বে বাংলাদেশ।এদিকে, কোপারনিকাস অ্যাটমোস্ফিয়ার মনিটরিং সার্ভিস ও কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস নিশ্চিত করেছে যে, লকডাউনের কারণে কার্বন নিঃসরণ কমে আসায় ওজন স্তরে যে বিশাল ক্ষত বা গর্ত তৈরি হয়েছিল তা পৃথিবী নিজেই সারিয়ে তুলছে। এর আগে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এপ্রিলের শুরুতে বরফে ঢাকা উত্তর মেরুর আকাশে ওজন স্তরে ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখ বর্গকিলোমিটারের একটি বিশাল গর্ত তৈরির কথা জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। এই গর্ত দক্ষিণের দিকে মোড় নিলে সরাসরি হুমকির মুখে পড়তো বিশ্ববাসী।
যানবাহন ও শিল্প কারখানার কালো ধোঁয়া বর্তমানে ঢাকার আকাশে নেই। সে কারণেই বায়ুদূষণের মাত্রা কমে এসেছে। সুতরাং বলা যায়, যারা বায়ুদূষণের সঙ্গে জড়িত এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের যারা তাদের মনিটরিং করবে, উভয়েই যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে তাহলে ঢাকার বায়ু স্বাস্থ্যকর থাকবে। শুধুমাত্র লোকাল পলিউশন নয়, এর সঙ্গে আরও অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে। যেমন: বায়ুপ্রবাাহ, বৃষ্টিপাত, অন্য স্থানের দূষণ হলেও তার প্রভাব ঢাকায় পড়তে পারে। তাই নগরবাসী সচেতন হলে ঢাকার বায়ু স্বাস্থ্যকর রাখা সম্ভব। পরিবেশ সুরক্ষায় প্রয়োজন সচেতনতা। সচেতনতার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুন্দর রাখতে পারি। এর ফলে বাঁচবে পৃথিবী, বাঁচবে মানবজাতি। এজন্য প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব চিন্তা-চেতনা।
ইলেকট্রিক্যাল অ্যাপলায়েন্সের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনা উচিত। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ শক্তি বাঁচানো সম্ভব। এছাড়া, পরিবেশবান্ধবের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সোলার পাওয়ার ব্যবহার করা যেতে পারে। কাঠের চুলার ব্যবহার যতোটা সম্ভব কমানো উচিত। কারণ কাঠের চুলা থেকে অত্যধিক পরিমাণে ধোঁয়া নির্গত হয়। যা বায়ুর সঙ্গে মিশে গিয়ে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। আমাদের পরিবেশবান্ধব যানবাহনের ওপর জোর দিত হবে। গাড়ির নির্গত ধোঁয়া বায়ুর সঙ্গে মিশে দূষণ ঘটাতে পারে। তাই দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবহার রা জরুরি। জোর দিতে হবে ইকোসিস্টেমকে সুস্থ রাখার বিষয়ে।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও বায়ুদূষণের কারণে ইকোসিস্টেম প্রভাবিত হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে গাছপালা, পশুপাখির ওপর। তাই ইকোসিস্টেম সুস্থ রাখার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। কীটনাশক ও কেমিক্যালের ব্যবহার কমাতে হবে। পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কার্বন ফুটপ্রিন্ট ও বায়ুদূষণ যাতে কম হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়ার কারণে বাড়তে থাকে বায়ুদূষণ। এছাড়া এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবহারও কম করা উচিত। বর্জ্য পদার্থ রিসাইকেল করতে হবে।
কাঁচ, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম বা খবরের কাগজ ফেলে দেয়ার পরিবর্তে রিসাইকেল করা প্রয়োজন। এর ফলে আবর্জনা জমে দূষণ ছড়াবে না। এমনকি এই বর্জ্যগুলো পোড়ানোর ফলে নির্গত ধোঁয়া পরিবেশের ক্ষতি করতে পারবে না। তাই প্লাস্টিক বা কাঁচের বোতল, এমনকি খবরের কাগজ না ফেলে পুনর্ব্যবহার করা যেতে পারে।নিজ নিজ এলাকায় ফল-সবজি উৎপাদন করা যেতে পারে। এর ফলে ফল-সবজি সরবরাহের জন্য যে গাড়ি চলাচল করা হয়, তা কমানো যাবে।
পাশাপাশি ফল ও সবজি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সংরক্ষণের জন্য কীটনাশক ও প্রিজারভেটিভের ব্যবহারও কম করা যাবে। এই প্রিজারভেটিভগুলো সরাসরি বায়ুদূষণ ঘটায়। অর্গ্যানিক খাদ্যবস্তুর ওপর গুরুত্ব দেয়া দরকার। নিজের বাগানে এগুলো উৎপাদন করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। বাড়িতে দূষিত ও টক্সিক জিনিসের ব্যবহার না করাই ভালো। বাড়ি থেকেই একটি সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। প্লাস্টিক টুথ ব্রাশ, ক্যান, বোতলের পরিবর্তে কাঠের জার ব্যবহার করা যেতে পারে।
আবার মশা বা আরশোলা মারার জন্য কেমিক্যালযুক্ত স্প্রে ব্যবহারের পরিবর্তে কিছু প্রাকৃতিক বা ঘরোয়া উপায়ে তৈরি সামগ্রী দিয়ে পোকামাকড় তাড়ানো সম্ভব। নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে হবে। বায়ু বা জল দূষণের কারণে পরিবেশকে দূষিত করে তোলার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ হতে পারে।বর্তমান সরকার পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন নীতির ওপর ভিত্তি করে ‘রূপকল্প ২০২১’ এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে।
পরিবেশ সংশ্লিষ্ট টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অধিদপ্তর বা সংস্থা নিজেদের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান সরকার পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কার্যকরভাবে মোকাবেলায় বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং সেগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদানপূর্বক বাংলাদেশের সংবিধানে পরিবেশ বিষয়ে একটি পৃথক অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সুস্থ পরিবেশকে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এছাড়া, বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ অভিঘাতের সাথে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজন এবং প্রশমন বা কার্বন নিঃসরণ হ্রাস- এ দুই খাতেই বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা, পানি ও বায়ুদূষণ এবং জীববৈচিত্র্য ও মাটির ওপর বিরূপ প্রভাবে পরিবেশের গুণগতমানের অবনতির কারণে মারা যাচ্ছে হাজারো মানুষ। আমরা যদি সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এর প্রতিকার না করি, তাহলে এর ফল হবে ভয়াবহ। ধ্বংস হবে প্রাকৃতিক সম্পদ, বাড়বে অভিবাসন এবং সেই সঙ্গে বাড়বে সংঘাত।
মহামারী থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে হলে মানুষের নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও সহিষ্ণু পৃথিবী গড়ে তোলার উপর জোর দিতে হবে। বিশ্বকে বসবাসযোগ্য করার লক্ষ্যে দূষণমুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর আমাদের বাংলাদেশ। তবে মানুষের সচেতনতার অভাবে আজ তা অরক্ষিত। নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। এ ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে অঙ্গীকার করি, সোনার বাংলা সবুজ করি’।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে দেশজুড়ে বৃক্ষরোপণসহ বিভিন্নমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণপূর্বক বাসযোগ্য টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণে নিরলসভাবে কাজ করে করছে। সরকারের সাথে জনগণকে নিজ ভূমিকা রাখতে হবে পরিবেশ রক্ষায় ।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ