রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীর মূল্যায়ন হোক মেধা ও মননে

নারীর মূল্যায়ন হোক মেধা ও মননে

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে সব নারীরা তাদের শ্রম, বুদ্ধি এবং সাহসিকতা দিয়ে সাহায্য করেছে তাদের সেই সব মহৎ কাজ খুব কমই আলাপচারিতায় আসে। যেন তাদের অঙ্গ ব্যবহার করে সম্মানহানী হওয়াটা মুক্তিযুদ্ধে তাদের মূল অবদান। এইসব অপ্রগতিশীল ধারণার পরিবর্তন হওয়া দরকার। বরং তারা যে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েও দেশের মুক্তির জন্য মানসিক শক্তি নিয়ে নানাভাবে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেছে সে বিষয়গুলো বারবার আলোচনায় আসা উচিৎ। এতে করে অঙ্গই যে মানুষের মূল সম্মানের বিষয় নয় ব্যাপারটা ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হতে থাকবে। ইজ্জৎ বা সম্মান শুধুই শরীর বা কোনো বিশেষ অঙ্গে সংরক্ষিত থাকে না। বরং এ বিষয়টার চেয়ে মেধা, পরিশ্রম ও সাহসিকতাকে আলাপচারিতায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে নারীদের বেশি সম্মানিত করা হবে বোধ করি।

যারা নারীর মূল্যায়ন করেন শুধুই রূপ, সৌন্দর্য, আর অঙ্গের আঙ্গিকে তাদের প্রগতিশীলতা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। প্রসঙ্গটা এজন্য যে, সার্বিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেসব নারী ধর্ষিত হয়েছিল তারা তাদের সম্মান হারায়নি। কেননা, তাদের সম্মান তাদের শরীরে নয়। বীরাঙ্গনাদের অঙ্গ নিয়ে বার বার সম্মান হারিয়েছে বলে সহমর্মিতা বা প্রশ্ন তুলে নারীদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তাতে সত্যিকার অর্থে তাদের অসম্মানিত করা হচ্ছে।

সম্মান তৈরি হয় মেধা, শ্রম ও মানুষের কর্মে। শরীরে কিংবা মনের আঘাতে নয়। বরং যারা আঘাত করে তাদের নিয়ে সমাজের কটাক্ষ করা উচিৎ। এখন থেকে ধর্ষিতা নয় বরং ধর্ষকদের নিয়ে আলোচনা সমালোচনা ও কথা বলাবলি হোক। একটি ধারণা একটি সমাজকে পরিবর্তন করে। শিশু বয়স থেকেই যদি মানুষকে শেখানো হয় যে কারো শরীরের অযোচিত আঘাত কিংবা অনিচ্ছাকৃত ব্যবহারের ওপর কারো সম্মান নির্ভর করে না। তাহলে বড়ো হয়ে তার মস্তিষ্কে সে ধারণাই বদ্ধমূল থাকবে। ধর্ষিতা নয় বরং ধর্ষককেই তারা ঘৃণা করতে শিখবে।

আরও পড়ুনঃ  ২০২৩ সালে তেলের উত্তোলন বাড়াবে রাশিয়া

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনো মনে করে সন্তান জন্ম, পালন ও ঘর সংসার সামাল দেয়া মূলত মেয়েদেরই কাজ। এমন কি বাইরে থেকে উপার্জন করে আনলেও ঘরের দায়িত্ব একা মেয়েদেরই। কাজ শেষে ফেরার সময় মেয়েটির অন্তর্গত চিন্তা থাকে ঘরে কি লাঞ্চ এবং কি ডিনার হবে। ঘরে ছেলেমেয়ে, বাচ্চা-কাচ্চারা না জানি কি করছে। এ সব তাদের মজ্জাগত অভ্যাস। আর এ অভ্যাস তাদের রমণীয় গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে করে সমাজ। কিন্তু তারা যে সংসারের বাইরেও সংসারের স্বাচ্ছন্দের জন্য বাড়তি উপার্জন করছে তার জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে না।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজে এখনো নারীর মূল্যায়ন ও সম্মান নির্ধারিত হয় তার শারীরিক বৈশিষ্ঠ্য ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিন্যাসে। অনেক পুরুষের সবচেয়ে আগ্রহের জায়গা একজন মেয়ের শারীরিক কাঠামো; দৃষ্টি জুড়ে, মনন জুড়ে শুধু বিশেষ কিছু অংশ ও অঙ্গ। এই মনোবৈকল্য যেসব পুরুষের, তাদের মনোজাগতিক সুস্থতা কামনা করা ছাড়া নারীদের আর কিইবা করার আছে! সমাজের অধিকাংশ পুরুষ মনে করে, নিজের মা-বোন ছাড়া যে কাউকে সুযোগ পেলেই যৌন হয়রানী করা যায়। তারা মনে করে নারী কেবল ‘মমতাময়ী’, ‘স্নেহময়ী’ হলেই তাকে সম্মান করতে হবে নয়তো যা ইচ্ছে তাই ভাবা যায়। বলা যায় তাকে নিয়ে। এই নিয়ে বেশির ভাগ পুরুষের আছে সনাতনী আগ্রহ এবং ইচ্ছাপূরণের অভিপ্রায়।

বহু বিষয়ে সমাজ এখনও নারীদের অবমূল্যায়ন করছে। অনেক অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্যের মাঝে এ প্রসঙ্গে শুধু ধর্ষণের কথাটি উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক। ধর্ষণ মানে ইচ্ছার বিরদ্ধে নারীর শরীর ব্যবহার। যখন কেউ নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক তার শরীরকে ব্যবহার করে সেটাই ধর্ষণ। একজন নারী ধর্ষিত হলে শাররিক ও মানসিকভাবে নিজেই হতাশ ও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। সেখানে সমাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করে অমানবিকভাবে, যেন ধর্ষিত হওয়াটা তার অপরাধ।

আরও পড়ুনঃ  নিউজ করলেই মামলা দিব

যেখানে সে নিজেই ভুক্তভোগী সেখানে সমাজ তাকে আরও নিন্দার দিকে ঠেলে দিয়ে শাররিক ও মানসিক সবদিক থেকে ধ্বংস করে ফেলে। সেটা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বলে কথা নয়। মেয়ে মাত্রই ধর্ষিত হলে তারা তখন হয়ে যায় ধর্ষিতা, যেন মানুষ নয়। হয়ে যায় অস্পৃশ্য ও সমালোচনার বস্তু। সমাজে সে আর সম্মানিত নয়। একজন ধর্ষিত নারীকে কোনো পুরুষ নিঃশঙ্কচিত্তে আর ভালোবাসতে পারে না কিংবা কোনো পরিবার তাকে আনন্দচিত্তে বউ হিসেবে গ্রহণ করতে চায় না। অথচ এটা তার শরীরের অনিচ্ছাকৃত ব্যবহার মাত্র। এই ধারণার আমূল পরিবর্তন দরকার সমাজে ও গোটা বিশ্বে।

নারীদের নিয়ে উপহাস কিংবা ব্যাঙ্গ করার বিষয়গুলোও পরিবর্তন হওয়া দরকার। নন্দন তাত্ত্বিক কিংবা সৌন্দর্যবোধ থেকে যে কোনো প্রশংসা অবশ্যই সম্মানের। কিন্তু নারীর শাররিক বৈশিষ্ঠ্য ও শাররিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অযোচিত আলোচনা ও কটাক্ষ অবশ্যই নারীর জন্য অসম্মানজনক। সেটা যতোই তুচ্ছ কিংবা ক্ষুদ্র হোক। মোটকথা মানসিকতার সার্বিক পরিবর্তনই দিতে পারে একজন নারীর যথাযথ সম্মান প্রাপ্তি। কোনো নারী ধর্ষিত হলে তার সম্মান কেন যাবে কিংবা কোনো নারী একা একা চলাফেরা করলে তাকে নিয়ে কেন কথা বলাবলি হবে তা অবশ্যই নতুন করে ভাবা দরকার।

সত্যিকার অর্থে নারীদের সম্মান প্রদর্শন হবে মানসিকতার পরিবর্তনে। এ পরিবর্তন আসতে হবে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা সুশীলদের কাছ থেকে। আসলে নারীবাদী হতে হবে পুরুষশ্রেণীর। যারা এখনো সমাজের নীতি-নির্ধারক। সারাদিন যে মেয়েটি সভা সেমিনারে নারীবাদ নিয়ে চেঁচামেচি করে সেই মেয়েটিই বাড়ি ফিরলে নির্যাতনের শিকার হয় নানাভাবে। সামাজিক সম্মান ও পারিবারিক নির্যাতনের ভয়ে মুখ ফুটে কারো কাছে কিছু বলতে পারে না কিংবা বলে না অশান্তির আতংকে।
নারী মানেই শুধু রূপের বন্দনা কিংবা ভোগের বস্তু নয়- এ ধারণার পরিবর্তন হতে হবে সুশীল সমাজ থেকেই। সে কারণে বছরে শুধু একদিন নারী দিবসের কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগ কিংবা শুভেচ্ছা বিনিময়য়েই দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়। জগতের সকল পুরুষের চিন্তা ও মননে নারীবাদী চেতনা লালন করা অর্থাৎ নারীদের সুযোগ তৈরি করার মানসিকতা থাকাই মুলতঃ একটি পরিছন্ন সমাজ গড়ার হাতিয়ার। এজন্য নারীর শাররিক শুচিতার চেয়ে তার মানসিক শুদ্ধতা’র মূল্যায়ন সবচে বেশি দরকার।

আরও পড়ুনঃ  বাজারে পেঁয়াজ নেই, বিক্রি হচ্ছে না মুরগি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে সব নারীরা তাদের শ্রম, বুদ্ধি এবং সাহসিকতা দিয়ে সাহায্য করেছে তাদের সেই সব মহৎ কাজ খুব কমই আলাপচারিতায় আসে। যেন তাদের অঙ্গ ব্যবহার করে সম্মানহানী হওয়াটা মুক্তিযুদ্ধে তাদের মূল অবদান। এইসব অপ্রগতিশীল ধারণার পরিবর্তন হওয়া দরকার। বরং তারা যে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েও দেশের মুক্তির জন্য মানসিক শক্তি নিয়ে নানাভাবে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেছে সে বিষয়গুলো বারবার আলোচনায় আসা উচিৎ। এতে করে অঙ্গই যে মানুষের মূল সম্মানের বিষয় নয় ব্যাপারটা ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হতে থাকবে। ইজ্জৎ বা সম্মান শুধুই শরীর বা কোনো বিশেষ অঙ্গে সংরক্ষিত থাকে না। বরং এ বিষয়টার চেয়ে মেধা, পরিশ্রম ও সাহসিকতাকে আলাপচারিতায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে নারীদের বেশি সম্মানিত করা হবে বোধ করি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন