ঢাকা | সোমবার
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ফিরতে হবে সরিষায়

ফিরতে হবে সরিষায়

আবহমানকাল থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে রান্না ছাড়াও বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হতো সরিষার তেল। এক সময় ভোজ্যতেল বলতে সরিষাকেই বোঝানো হতো। গ্রামাঞ্চলে সরিষার ব্যাপক আবাদ হতো। ঘনিতে সরিষা ভেঙে পাওয়া যেত তেল। আজ থেকে তিন দশক আগেও বাজারে সরিষার তেলের জয়-জয়কার ছিল। তবে আমেরিকার সয়াবিনের আগ্রাসনে পুষ্টি উপকরণে সমৃদ্ধ সেই দেশীয় ভোজ্যতেলের বাজার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। তবে সম্প্রতি সয়াবিনের চরম সংকটে দেশীয় সরিষার দিকে ফিরে আসার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

কয়েক দশক আগে যাদের গ্রামে জন্ম হয়েছে তারা আজও স্মৃতিতাড়না অনুভব করেন সরিষার আবাদ আর তেল ঘিরে। তেমনি দুজন ব্যক্তি শফিকুর ও তানভীর। চাকরি সূত্রে রাজধানীতে থাকছেন বহুদিন ধরে। জানতে চাইলে দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ছোটবেলায় গ্রামে দেখতাম মানুষ বাজার থেকে তেল কিনতে বোতল সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। বোতলের মুখে পাটের রশির বাঁধা থাকতো। বাজারের দোকানে ঝুলিয়ে রাখতেন। অন্যান্য সব সদাই কিনে বাড়ি ফেরার সময় বোতলে সরিষার তেল নিয়ে ফিরতেন। তখন সরিষার তেলের দোকানে ঝুলিয়ে রাখা হতো সরিষার তেলের বোতল।

শফিকুর আর তানভীর আরো বলেন, সে সময় কেউ আধা সের আবার কেউ বা এক পোয়া কিংবা আরো কম সরিষার তেল কিনতেন। সেই তেলেই চলে যেত এক সপ্তাহ। সেই হাটের দিন আসার আগ পর্যন্ত ব্যবহার চলতো। অথচ এখন সময় পাল্টে গেছে। সরিষার জায়গায় হানা দিয়েছে সয়াবিন, সূর্যমুখি, পাম ও অলিভ ওয়েল।

গ্রাম থেকে রাজধানীতে চাকরিসূত্রে বসবাসকারী আরেক ব্যক্তি সোলায়মান হোসেন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সরিষার তেল কিনতাম না আমরা। বরং জমিতে যে সরিষার চাষ হতো, তা ঘনিতে ভেঙে নিয়ে সেই তেলে সারাবছর চলতো। তখন সরিষার তেলের ঘ্রাণ ছিল অসাধারণ। শুধু রান্নাতেই নয়, আরে বহু কাজে ব্যবহার হতো সরিষার তেল। সোয়ালমান আরো বলেন, আগে ঠাণ্ডা লাগলে সরিষার তেল দিয়ে কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে মুড়িমাখা খেলে চলে যেত সর্দি-কাশি। গোসল শেষে শরীরেও মাখানো হতো তেল।

শফিকুর, তানভীর সোলায়মানরা বলেন, সরিষার জায়গায় সয়াবিন এসে সব উল্টেপাল্টে গেছে। মানুষের মাঝে রোগবালাইও বেড়েছে। এখন সরিষার জায়গা দখল করেছে বিভিন্ন লোশন। ভাজি, ভর্তা ও তরকারিতে সরিষার বদলে জায়গা করে নিয়েছে সয়াবিন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমেরিকার প্রলোভনে পড়ে সরিষা ছেড়ে আমরা সয়াবিনে ঝুঁকে পড়েছি। আশির দশকে নানা ধরনের অসুখের কথা বলে সরিষা থেকে ভোক্তাদের মুখ ফেরাতে প্রচারণা চালায় আমেরিকা। অবশেষে তারা সফলও হয়। আবহমানকালের সরিষা রেখে কম দামের সয়াবিন, পাম ওয়েলে ডুব দেয় মানুষ। এখন তার খেসারত দিতে হচ্ছে। এক কেজি সয়াবিনের তেল কিনতে ব্যয় করতে হচ্ছে ২০০ টাকা। তাও আবার বেশিরভাগ সময় বাজারে মিলছে না। অথচ এক সময় চাহিদার শতভাগই মেটানো হতো সরিষার তেলে। এখন সেটা ঘুরে চলে গেছে সয়াবিনের ঘরে।

বাংলাদেশের মানুষ কেন সরিষা ছেড়ে সয়াবিন বেছে নিলেন সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. আব্দুল মালেক দৈনিক আনন্দবাজারকে জানালেন, সরিষার মধ্যে যে পুষ্টি সেটি কিন্তু সয়াবিনে নেই। তারপরও মানুষ সয়াবিনে ঝুঁকে পড়ার কারণ হচ্ছে আমেরিকার একতরফা প্রচার। তারা আশির দশকে কম দামে, এমনকি বিনামূল্যে সয়াবিন তেল রপ্তানি করতে থাকে। সস্তা দেখে বাংলাদেশের মানুষ সরিষা ছেড়ে বেছে নেয় সয়াবিন। অবস্থা এখন এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সরিষার তেলের ব্যবহারই ভুলে গেছে মানুষ।

বিনার সূত্রমতে, দেশে ভোজ্যতেল হিসেবে প্রধানত সরিষার আবাদ করা হয়। এতে প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ তেল এবং ২০-২৫ শতাংশ প্রোটিন থাকে। যদিও দেশে তেলবীজের আবাদ করা জমির প্রায় ৬০ শতাংশে সরিষা চাষ করা হয়। তারপরও ২০১৯ সালে প্রায় দশমিক ৪৬ লাখ টন সরিষা আমদানি করা হয়েছে। দেশে প্রায় সব এলাকাতেই রবি মৌসুমে সরিষা চাষ করা হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে ২০১৭-২০১৮ সালে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৮৭৪ একর জমিতে ৩ লাখ ৫১ হাজার ৫৩৭ মেট্রিক টন সরিষার তেল উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে ৬ লাখ ৬৭ হাজার ২৪২ একর জমিতে ৩ লাখ ১১ হাজার ৭৪০ টন ও ২০১৯-২০ সালে ৭ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫৫ একর জমিতে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ২৪৯ টন সরিষার তেল উৎপাদন হয়েছে।

বিনার উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) ও বিভাগীয় প্রধান ড. শামছুন্নাহার বেগম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, সরিষার উৎপাদন বাড়াতে বিনার বেশকিছু প্রকল্প রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে সরিষার তেলের উৎপাদন অনেকাংশে বাড়বে। সয়াবিন কেনার বৈদেশিক মুদ্রাও বাঁচবে।

বিনার উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের উপ-প্রকল্প সমন্বয়ক ড. রেজা মোহাম্মদ ইমন জানান, দেশের দুই ফসলের মাঝের ২২ লাখ হেক্টর পতিত জমিতে বিনাসরিষা-৪ ও বিনাসরিষা-৯ আবাদ করে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি সাশ্রয় করা সম্ভব। আমন আর বোরোর মাঝে যদি এই পতিত জমি চাষের আওতায় আনা যায় তাহলে বছরে তেলের উৎপাদন আট থেকে ১০ লাখ টন বাড়বে। এতে এখন যে ১৭ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি করতে হয় সেটির প্রয়োজন পড়বে না।

তথ্যমতে, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা বছরে ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে সরিষার তেল উৎপাদিত হয় পাঁচ লাখ টন। বাকি ১৯ লাখ টনের মধ্যে সয়াবিন তিন লাখ টন ও পাম অয়েল ১২ লাখ টন আমদানি হয়। অথচ ১৫ লাখ টন তেল আমদানি না করে পতিত জমিতে বিনাসরিষা-৯ ও ৪ চাষ করা হলে তেল আমদানির ১৭ হাজার কোটি টাকা সশ্রয় হবে।

কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের খাদ্যভ্যাস পরিবর্তনের কারণে তেলের ব্যবহার বেড়েছে। তবে চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, চাষিরা সাধারণত ধান কাটার পর সেখানেই সরিষার দানা ছিটিয়ে দেন। সেখানে বেশি সেবাযত্ন করেন না। ফলন যা হয় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেন। অথচ বিনাসরিষা-৪, ৯, ও ১১ চাষের সময় লাইন দিয়ে এবং কিছু যত্ন নিলে প্রচুর ফলন হতে পারে।

উদ্ভিদ প্রজনন বিষয়ক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রেজা বলেন, আমাদের উদ্ভাবিত সরিষা এক বছরের মধ্যেই কৃষকের কাছে দিয়ে দেওয়া হয়। সবগুলো জাত হয়তো জনপ্রিয়তা পায় না, তবে কিছু কিছু জাত চাষিরা গ্রহণ করছেন। বিনার উদ্ভাবিত ১১টি জাতের মধ্যে বিনাসরিষা ৪, ৯ ও ১১ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এসব সরিষার চাষ ব্যাপক আকারে করতে পারলে সরিষার হারানো স্থান আবার ফিরে পাবে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন