ঢাকা | রবিবার
২৩শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৯ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঋণ-প্রকল্পের বিলাসী ফাঁদ

ঋণ-প্রকল্পের বিলাসী ফাঁদ

শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকট এখন রূপ নিয়েছে চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় সংকটে। দেশটির নেতারা এ সংকটকে করোনা মহামারির ফল বলে দাবি করে দায় এড়াতে চাইলেও বাস্তবতা মোড় নিচ্ছিলো ভিন্ন দিকে। সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর প্রবণতা পরিস্থিতিকে নিয়ে গেছে বহুদূর। সর্বশেষ যা জনরোষে পরিণত হয়ে পুড়াচ্ছে গোটা দেশকে।

প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী তো বটেই, জনরোষ থেকে ছাড় পাচ্ছেন না লঙ্কান মন্ত্রী, এমপি, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারাও। পথ আটকে তাদের ওপর যেমন শারীরিক আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, তেমনি আগুন লাগানো হয়েছে অর্ধশতাধিক নেতার বাড়িগাড়িতে। এর মধ্যে একরাতেই বিক্ষোভের আগুনে পুড়েছে শ্রীলঙ্কার অন্তত ৩৩ সংসদ সদস্যের বাসভবন। প্রশ্ন ওঠছে হঠাৎ করেই এ আগুন জ্বলে উঠলো কেন?

কয়েক বছর ধরেই অর্থনৈতিক সংকট চলছিল দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কায়। তবে এ বছরের শুরু থেকেই এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। এই পরিস্থিতিতে দেশটি বাঁচবে কীভাবে, তা নিয়েই এখন জল্পনা–কল্পনা। এমন সংকট আর কখনো দেখেনি নাগরিকরা। সরকার বাধ্য হয়েছে বিদেশি ঋণদাতাদের কাছে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে।

অথচ কয়েক বছর আগেও দেশটিতে দেখা হতো এশিয়ার রোল মডেল হিসেবে। বৈদেশিক মুদ্রার কোষাগারে দুই বছর আগেও ছিল সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষায়-চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকা দেশটির মাথাপিছু আয়ও কয়েক বছর ছিল ৩৮শ ডলারের বেশি। গত দুই দশকের অব্যাহত ঋণের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প আর বেশ কিছু অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত ডুবিয়েছে এক সময়ের ‘জুয়েল অব দ্য ক্রাউন’ খ্যাত দেশটিকে।

বৈদেশিক ঋণেরভারে জর্জরিত শ্রীংলকা। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছে না। জিনিসপত্রের দাম এখন আকাশছোঁয়া। জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে দেশটিতে। তেল সংগ্রহের জন্য হাজার-হাজার মানুষ লাইনে ভিড় করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের পেট্রোল পাম্পগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছিল দেশটির সরকারকে। এর পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণে রয়েছে।

ঋণের প্রকল্প বিলাস
গত ১৫ বছরে শ্রীলংকা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরো নানা ধরণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। রাজধানী কলম্বোর কাছেই সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে কলম্বো পোর্ট সিটি নামে আরেকটি শহর তৈরি করা হচ্ছে।

এর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২৫ বছর এবং বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। বলা হয়, হংকং, দুবাই এবং সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দেবে নতুন এই শহর। চীনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শ্রীলংকা।

দেশটি একসময় চীনের ঋণে হামবানটোটা বন্দর বানিয়ে জনগণকে মুগ্ধ করেছিলেন। পরে দেখা গেল সেই সমুদ্রবন্দর এবং পাশের মাত্তালায় বানানো ‘রাজাপক্ষে বিমানবন্দর’ থেকে প্রত্যাশামতো আয় আসছে না। প্রায় দুশ মিলিয়ন ডলারে বানানো এখানকার বিমানবন্দরটিতে দিনে মাত্র দুটি বিমান ওঠানামা করতে দেখে ২০১৬ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে কম ব্যবহৃত বিমানবন্দর’ উপমা দেয়। যেটি তৈরি হয় চীনের এক্সিম ব্যাংকের উচ্চ সুদের ঋণে। দেনা মেটাতে না পারায় পরে হামবানটোটা সমুদ্রবন্দর চীনের কাছেই সোয়া বিলিয়ন ডলারে লিজ দিতে হয়েছে।

চীন ছাড়াও শ্রীলঙ্কা বড় অঙ্কের ঋণগ্রস্ত হয়ে আছে এডিবি, বিশ্বব্যাংক ও জাপানের কাছেও। সংকট সামাল দিতে ভারতের কাছেও বার বার হাত পেতেছে দেশটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে শ্রীলংকা ঋণ নিয়েছে। বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি। ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার সরকারি ঋণ ছিল জিডিপির ৯৪ শতাংশ এবং ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় জিডিপির ১১৯ শতাংশে।

বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ পরিশোধে প্রতি বছর ৭ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। বেশিদিনের জন্য ও কম সুদে ব্যাপক পরিমাণে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। তবে ‘শক্তিশালী’ শ্রীলঙ্কার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গোতাবায়া রাজাপাকসে ভোটের বাক্সে যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন, তা অর্থনীতির হিসেবে কাজে দেয়নি বলাই বাহুল্য। দেশটি এখন আকণ্ঠ নয়, আপাদমস্তক ঋণের সাগরে নিমজ্জিত। ঋণ থেকে উদ্ধার পেতে আরও ঋণের দিকে যেতে যেতে দেউলিয়া হয়ে পড়ে দেশটি।

কৃষিতে ধস
২০১১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশটিতে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারী করেছেন। এর ফলে মৌলিক খাদ্যপণ্যের সরবরাহ এখন সরকার নিয়ন্ত্রণে নেয়। তবে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। এখন যেটি প্রায় ৩০ শতাংশ ছুঁয়েছে।

শ্রীলঙ্কার কৃষিকে রাতারাতি জৈব চাষে রূপান্তরিত করার সরকারি প্রচেষ্টার ফলে উৎপাদনে মারাত্মক ক্ষতি হয়। এটি শ্রীলঙ্কাকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবল সংকটের মধ্যেও তার প্রধান খাদ্য চাল আমদানি করতে বাধ্য করে। সেখানে শ্রমিকের মজুরি বেশি। এতো মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষির যন্ত্রীকরণ শুরু করেছিল তারা, কিন্তু উৎপাদন শেষমেশ বৃদ্ধি করতে পারেনি।

সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অভূতপূর্ব পরিমাণে ঋণ নেয়। এতে রাজস্ব হ্রাসের চরম ঘাটতি দেখা দেয়। অন্যদিকে গোতাবায়ার সরকার আয়কর এবং মূল্য সংযোজন করদাতাদের জন্য একটি অযাচিত কর ছাড় দিয়েছিল। এতে ৫০ হাজার কোটি রুপির রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। অর্থাৎ এ সিদ্ধান্ত বার্ষিক জিডিপির প্রায় ৪ শতাংশ রাজস্বের ক্ষতি করেছিল।

তাছাড়া অনেক মনে করেন, লঙ্কার এখনকার সংকটের একটি বড় কারণ করোনা মহামারি। করোনাকাল দেশটির রোজগারের বড় জায়গা পর্যটনকে বিপদে ফেলেছে। মানুষের বেড়াতে আসা বন্ধ ছিল বহুদিন। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটেও পর্যটক আরেক দফা কমেছে। তবে পর্যটন খাত থেকে বছরে দেশটির আয় হয় ৪০০ কোটি ডলার। এ অর্থ দেশটির অভ্যন্তরীণ আয়ের মোট অর্থের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রকৃত জিডিপিতে পর্যটনের অবদান মাত্র ১.৫ শতাংশ। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির আঘাতে অর্থনীতি ৩ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হয়।

বিশ্লেষকেরা বলেন, ঋণখেলাপি শ্রীলঙ্কার সর্বনাশের মূল কারণ হলো, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় বন্ড বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নির্বিচার বিক্রি করা। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা সরকার আগপিছ বিবেচনা না করে ডলারে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে। এই ডলারভিত্তিক সঞ্চয়পত্র দেশটির সর্বমোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় অর্ধেক। রাষ্ট্রীয় রিজার্ভে ডলারের পরিমাণ তলানিতে ঠেকার কারণে এই সঞ্চয়পত্রের কিস্তিভিত্তিক মুনাফার অর্থ দিতে শ্রীলঙ্কা সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

সরকারের এ ব্যর্থতায় কীভাবে ঘুরে দাড়াঁবে দেশটি সেই প্রশ্নই বড় করে সামনে আসছে এখন। নেপালের পরিস্থিতিও শ্রীলঙ্কার দিকেই যাচ্ছে। ফলে ভুল নীতির খেসারত কাটিয়ে ওঠার নয়া কৌশল নিয়ে ভাবছে অর্থনীতিবিদরা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন