বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসারের ব্যয় মেটাতে ঋণের দিকে ঝুঁকছেন নিম্ন থেকে মধ্যআয়ের মানুষ। ঋণ করে কোনোরকমে দিন-যাপনের চেষ্টা করছেন তারা। অনেকের আবার ধার-কর্জ কিংবা ঋণ করার জায়গাও বন্ধ হয়ে গেছে। দৈনন্দিন বাজেট কমাতে কমাতে খাওয়া খরচ কমিয়ে দিয়েছেন অনেক পরিবার। এরপরও সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
এদিকে চাল, ডাল, তেল, শাকসবজি, মাছ-মাংসসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। তাই ডাল-ভাত খেয়ে জীবন ধারণ করাও এখন মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। ঋণ করে সংসার চালাতেও হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। এদিকে রোজাকে সামনে রেখে কাঁচা শাকসবজি ডাল, রসুন, চালসহ নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা লেগেই আছে। দাম কমিয়ে সঠিকভাবে বাজার তদারকতার কথা বলছেন বিশ্লেষকরা।
নিত্যপণ্যের বাজারে যেন আগুন লেগে আছে। আর সে আগুনে প্রতিনিয়ত পুড়ছে সাধারণ ক্রেতা। এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলেও ছোট একটি পরিবারের তিন-চার দিনের প্রয়োজনীয় বাজার করা সম্ভব হচ্ছে না। সয়াবিন তেলের দাম তো আকাশচুম্বী। ভালো মানের চিকন চাল তিন মাস আগে ৫৫ টাকা, সে চাল আজ ৬৮ টাকা। ২ কেজি আটার প্যাকেটের দাম এখন ৯০ টাকা, যা চার মাস আগে ছিল ৬৫-৭০ টাকা। গরুর মাংসের কেজি এক লাফে উঠেছে ৬শ ৫০ টাকায়। মাছে ভাতে বাঙালি প্রবাদে থাকলেও ব্যাস্তবে তা আর নেই।
গরীবের মাছ হিসেবে পরিচিত পাঙ্গাশ মাছ তাও এখন ১৩০-১৫০ টাকা কেজি। রোজার মাসে ছোলার ব্যবহার বাড়ে। সব শ্রেণির মানুষ ইফতারিতে ছোলা খায়। এ ছোলার বাজারেও লেগেছে আগুন। রোজায় ভোক্তার চাহিদায় থাকে দুধ আর সে দুধের দামও বাড়তি। সব ধরনের গুঁড়া দুধের দাম এক বছরের ব্যবধানে কেজিতে প্রায় ১শ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ১ কেজি ডানো গুঁড়া দুধ ৬শ ৯০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৬০০ থেকে ৬১০ টাকা। ডিপ্লোমা ব্র্যান্ডের (নিউজিল্যান্ড) গুঁড়া দুধ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬শ ৮০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৬১০-৬৩০ টাকা।
নওগাঁর কাঁচা বাজারে রিকশা-চালক শমসের আলী (৫০), ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে নওগাঁর মাস্টারপাড়ার বউবাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। সংসারের খরচ মেটাতে চার মাস আগে একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিন ৩৫ হাজার টাকা। সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধের পর সপ্তাহ শেষে তেমন কিছু আর থাকে না হাতে। তাই মাছ-মাংস কিনতে পারছেন না মাস শেষেও। তাই বাধ্য হয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া বড় ছেলেকে কাজে লাগীয়ে দিয়েছেন। ঋণটা পরিশোধ হলেই গ্রামের বাড়ি চলে যাবেন। মাস শেসে অন্তত বাসা ভাড়ার চাপটা তো থাকবে না! গ্রামে দিনমুজুরির কাজ করে খেয়ে না খেয়ে কোনোরকমে চালিয়ে নেবেন সংসার বলে জানান শমসের।
অপর দিকে স্কুল শিক্ষক রায়হান আলম জানান, তিনি জেলার সুনামধন্য একটি কিন্ডার গার্ডেন স্কুলের শিক্ষকতা করছেন দশ বছর ধরে। থাকেন নওগাঁ শহরের উকিলপাড়ায় ভাড়া বাসায়। চারজনের সংসারে গত দশ বছরে কোনো টানাপোড়েন ছিল না। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে গত প্রায় দেড় বছর অর্ধেক বেতন পেয়েছেন। স্কুলে ফুল বেতন দেওয়া শুরু হয়েছে কয়েক মাস হলো। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় করোনা মহামারির এ দুই বছরে বাসা ভাড়াসহ পরিবারের চাহিদা মেটাতে এক লাখ টাকার বেশি ধার করেছেন কয়েকজনের কাছ থেকে। তা পরিশোধও করতে পারছেন না। তাই এখন কম ভাড়ার বাসা খুঁজছেন। কিন্তু বাজেটের মধ্যে বাসা পাচ্ছেন না।
আবার উচ্চ ভাড়া দিয়ে বর্তমানে অবস্থানরত বাসাতে থাকতেও পারছেন না।
শিক্ষক রায়হান আলম পড়েছেন উভয় সংকটে। তিনি বলেন, ভাই, নিরুপায়। আমরা দুজন মিলে আয় করি এরপরও সামলাতে পারছি না। মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। ছেলেদের খেলনা কেনা বন্ধ করে দিয়েছি। আর কোন দিক দিয়ে খরচ কমাব বুঝতে পারছি না। শুধু শমসের আলী আর রায়হান আলম-ই নয় এ জেলার শত শত পরিবার আজ ঋণের জালে আবদ্ধ। ঋণের চাপ মাথায় নিয়ে কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আবার কেউ গ্রাম বা শহর ছাড়া হচ্ছেন।
এ বিষয়ে সামাজিক সংগঠন একুশে পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ডিএম আব্দুল বারী’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উন্নয়ন হচ্ছে, কিছু মানুষের আয় বেড়েছে এটা সঠিক। কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা হলো জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারছে না সরকার। এ ছাড়া মানুষের আয় যাদের কমেছে তাদের প্রয়োজনমতো সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সমাজে প্রকটভাবে বেড়েছে বৈষম্য। নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষ জীবন বাঁচাতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। নিত্যপণ্যের বাজারে তেমন কোনো তদারকিতা নেই। সারা বছর দু-একটি ভেজালবিরোধী অভিযান চোখে পড়ে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। ফলে অতি মুনাফালোভী কিছু অসাধু ব্যবসায়ি সুযোগ পেয়ে যায়। আর ইচ্ছেমত বাজার নিয়ন্ত্রন করে। এতে পণ্যমূল্য বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি। এখন বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। সেই সঙ্গে নিম্নআয়ের মানুষদের সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। তা হলেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কিছুটা সম্ভব হবে।
নওগাঁ জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান বলেন, বাজার মনিটরিং টিম প্রতিনিয়তই নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। এছাড়াও টিসিপির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কম টাকায় বিক্রি করে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। খুব শিগগিরই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
আনন্দবাজার/শহক