ঢাকা | শুক্রবার
৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইউক্রেনে কেন ‘সামরিক অভিযান’ ব্যাখ্যা দিলেন রুশ রাষ্ট্রদূত

ইউক্রেনে কেন ‘সামরিক অভিযান’ ব্যাখ্যা দিলেন রুশ রাষ্ট্রদূত

ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যুতে বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম পশ্চিমা গণমাধ্যমের মতো পক্ষপাতদুষ্ট খবর প্রচার করছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশের রুশ দূতাবাস।

আজ রোববার বাংলাদেশে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দার ভি মানতিতস্কি স্বাক্ষরিত এক খোলা চিঠিতে কেন রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে এই বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং এই ইস্যুতে পক্ষপাতমূলক খবর প্রচার না করার আহ্বান জানানো হয়। 

চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আমি  ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমা সংবাদ সংস্থা, প্রকাশনা ও ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্লেষণমূলক লেখা সংগ্রহ করেছি। সেসব লেখায় রুশবিরোধী প্রোপাগান্ডা রয়েছে। কখনো কখনো ওই সব লেখায় এমন কিছু কথা প্রচার করা হয়েছে, যেগুলো প্রচণ্ড পক্ষপাতমূলক।’

‘তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের দেখাদেখি বাংলাদেশেও নির্দিষ্ট কয়েকটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে এ ধরনের প্রচারণা চলছে।’

তিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে লিখেছেন, ‘কিয়েভে বসবাসরত রুশ ভাষাভাষীদের ওপর দীর্ঘ ৮ বছর ধরে গণহত্যা চালাচ্ছে ইউক্রেন। আমরা তা প্রতিহত করতে চাই। নব্য ফ্যাসিবাদের অবসান চাই। ইউক্রেনে পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধ করতে চাই এবং ইউক্রেনে ন্যাটোর সামরিক ঘাঁটি স্থাপন রুখতে চাই।’

রাশিয়ার পার্লামেন্টের অনুমতি নিয়ে জাতিসংঘ সনদের ৫১ ধারার সপ্তম অধ্যায় অনুসরণ করেই ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হচ্ছে বলে তিনি ওই চিঠিতে দাবি করেছেন। দোনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক ও লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহায়তার চুক্তি যা ২২ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষর হয় সেটি বাস্তবায়নে মস্কো একটি বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করেছে বলে জানান তিনি।

রুশ রাষ্ট্রদূত লিখেছেন, ‘ইউক্রেনের সঙ্গে আমরা যুদ্ধে লিপ্ত নই। রাশিয়ার নিরাপত্তা হুমকির মুখে থাকায় আমরা এই অবস্থান নিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিগত ৩০ বছর ধরে আমরা ইউরোপে সমান এবং অবিভাজ্য নিরাপত্তার নীতির বিষয়ে নেতৃস্থানীয় ন্যাটো দেশগুলোর সঙ্গে একটি চুক্তিতে আসার চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রস্তাবের জবাবে, আমরা সবসময়ই হয় নিষ্ঠুর প্রতারণা, মিথ্যাচার অথবা চাপ-ব্ল্যাকমেইলের প্রচেষ্টার মুখোমুখি হয়েছি। আমাদের প্রতিবাদ এবং উদ্বেগ সত্ত্বেও উত্তর আটলান্টিক জোট এই অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়েছে।’

‘রাশিয়ার সীমান্তে সামরিক অস্ত্র নিয়ে আসা হচ্ছে দাবি করে’ তিনি বলেন, ‘তারা সামরিক অস্ত্র আমাদের সীমান্তের কাছে নিয়ে আসছে। এতো কিছু সত্ত্বেও, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমরা ইউরোপীয় নিরাপত্তা ও ন্যাটোর অ-সম্প্রসারণের নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের প্রচেষ্টা বৃথা ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান পরিবর্তন করেনি।’

‘শেষ পর্যন্ত, ন্যাটো দাবি করেছে যে, ইউক্রেনকে ব্লকে যোগদানের জন্য স্বাধীন হতে হবে, ইউক্রেনে নৌ ঘাঁটি স্থাপন করা হচ্ছে এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের জন্য সরাসরি হুমকি হতে পারে এমন ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এমনকি ইউক্রেনকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের সময়, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এমন নথি তুলে ধরেছিল যা নিশ্চিত করে যে ইউক্রেনের কিয়েভ, লিভভ, খারকভ, ডিনিপ্রো, খেরসন, টারনোপোল, উজগোরড, ভিনিতসিয়াতে কমপক্ষে ৩০টি জৈবিক পরীক্ষাগার এবং গবেষণা কেন্দ্রের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। পেন্টাগনের ন্যাশনাল সেন্টার ফর মেডিকেল ইন্টেলিজেন্সের স্বার্থে যেগুলোর অর্থায়ন করছে যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স থ্রেট রিডাকশন এজেন্সি (ডিটিআরএ)।’

‘ওই গবেষণার ফলাফল ইউএস আর্মি মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইনফেকশাস ডিজিজেস, ওয়াল্টার রিড আর্মি ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ, ইউএস নেভাল মেডিকেল রিসার্চ এবং ফোর্ট ডেট্রিকের ইউএস আর্মি বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার ল্যাব- যেগুলো আমেরিকান জৈবিক অস্ত্র কর্মসূচির মূল কেন্দ্র সেখানে পাঠানো হয়েছিল।’

‘উল্লিখিত ইউক্রেনীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক জৈবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে যার লক্ষ্য প্লেগ, অ্যানথ্রাক্স, টুলারেমিয়া, কলেরার রোগজীবাণু বৈশিষ্ট্য বাড়ানোর পাশাপাশি পরিযায়ী পাখির মাধ্যমে বিপজ্জনক সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে অধ্যয়ন করা, এর মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত প্যাথোজেনিক এইচ৫এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা (৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষের জন্য প্রাণঘাতী) এবং সিন্থেটিক জীববিজ্ঞানের সাহায্যে নিউক্যাসল রোগ,’ চিঠিতে বলা হয়েছে।

রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দার ভি মানতিতস্কি আরও জানান, ‘ইউক্রেনের গবেষণাগারে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাল প্যাথোজেনগুলোর অধ্যয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল, যা বাদুড় থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ হতে পারে। যেমন- প্লেগ, লেপ্টোস্পাইরোসিস, ব্রুসেলোসিস, করোনাভাইরাস ও ফিলোভাইরাসের প্যাথোজেন।’

‘যারা ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করছে তারাই এর জন্য দায়ী’ বলে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘পশ্চিমারা ইউক্রেনে কয়েক হাজার ম্যান পোর্টেবল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমসহ (ম্যানপ্যাডস) প্রাণঘাতী অস্ত্রের সরবরাহকে উত্সাহিত করার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই হাজার হাজার ম্যানপ্যাডস কোথায় শেষ হবে? এই ম্যানপ্যাডস পরবর্তীতে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে? যারা ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ করছে তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে তারা তাদের কর্মের জন্য দায়ী।’

চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘কয়েক বছর ধরে, আমরা ইউক্রেনকে একটি “রাশিয়া-বিরোধী” রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরের চেষ্টা লক্ষ্য করছি। এই শতকের গোড়ার দিকে পশ্চিমারা প্রকাশ্যে ইউক্রেনের কাছে প্রতিটি নির্বাচনের আগে পশ্চিমা দেশ ও রাশিয়ার মধ্যে একটি পছন্দ করার দাবি জানায়। আমরা চাই না ইউক্রেন একটি নব্য-নাৎসি রাষ্ট্রে পরিণত হোক যেখানে এসএস স্ট্রাইপ পরা ব্যাটালিয়নরা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সামনে মিছিল করে এবং যেখানে সেই জঙ্গিদের সন্ত্রাসী হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।’

রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমাদের ইতিহাসের সব পর্যায়েই আমরা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে পারি যে এইবার আমরা একটি সুস্থ মানসিকতা নিয়ে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসব। পশ্চিমা বিশ্ব যে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হতে পারে এবং প্রয়োজনে তার নিজস্ব মূল্যবোধ ছাড়তেও দ্বিধা করে না এই বিষয়ে আমাদের আর কোনো বিভ্রান্তি থাকবে না। আমরা আমাদের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে কখনোই পশ্চিমের উপর নির্ভর না করার জন্য আমাদের ক্ষমতার সমস্ত কিছু করব।’

চিঠির শেষে রুশ রাষ্ট্রদূত লিখেছেন, ‘পরিশেষে আমি বলতে চাই যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান নিয়ে বাংলাদেশি গণমাধ্যমের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সেই অপশক্তির ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার ফল, যারা সবসময় রাশিয়ান ফেডারেশন এবং বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ককে ক্ষুণ্ন করতে চেয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ৫০ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সক্রিয় সমর্থনে অবাঙালি প্রভুদের আধিপত্য, বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে হয়রানি, বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করতে বাংলাদেশিদের ৯ মাস সময় লেগেছিল, যাতে তারা স্বাধীনতা পায়, স্থানীয় ভাষায় কথা বলার অধিকার পায়। পূর্ব ইউক্রেনের দনবাসের রুশ-ভাষী লোকেরা গত 8 বছর ধরে একই অধিকার পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে, তারা কিয়েভ শাসনের দ্বারা
গণহত্যার শিকার হচ্ছে। একই কারণে, মাতৃভাষা বলার অধিকার নিশ্চিত করতে এবং ভাষাভিত্তিক বৈষম্যের অবসান ঘটাতে রাশিয়ার আবারও এসেছে।’

সবশেষে তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে পক্ষপাতদুষ্ট খবর প্রচার না করার অনুরোধ করেছেন।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন