ঢাকা | সোমবার
৩০শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৫ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুষ্টিয়ায় ‘ইস্ট ইন্ডিয়ার’ তামাকফাঁদ

কুষ্টিয়ায় ‘ইস্ট ইন্ডিয়ার’ তামাকফাঁদ

কুষ্টিয়ায় বেড়েই চলেছে তামাক চাষ। বিভিন্ন কোম্পানির প্রলোভনে জীবনের ঝুঁকি জেনেও তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন চাষিরা। এতে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে এবং ফসল আবাদ কমে যাচ্ছে। জেলার মিরপুর, ভেড়ামারা, দৌলতপুর উপজেলার ফসলি জমিতে শুধু তামাকের ক্ষেত। ঝুঁকি নিয়েই সকাল থেকেই বিকেল অবধি তামাক ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষকরা।

অতিরিক্ত সার ব্যবহারের ফলে ফসলি জমি দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। জেলার তামাক কোম্পানিগুলোর লোভনীয় প্রস্তাবে তামাক চাষ করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন প্রান্তিক চাষিরা। আর লাভবান হচ্ছে তামাক কোম্পানি এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞের মতে, তামাক চাষ বন্ধ না হলে এ জেলায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। আর কৃষি বিভাগ বলছে, তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে অন্য ফসল চাষে। ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে কুষ্টিয়ায় তামাকের আবাদ।

চাষিরা জানান, তামাক লাগানোর শুরু থেকেই বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিরা আমাদের সহায়তা করে থাকে। সার-বীজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামগ্রী প্রদান করে এবং ভালো দামেরও নিশ্চয়তা দেয়। তাছাড়া টার্গেটের জন্য আলাদাভাবে কার্ড তৈরি করে দেয়। যার ফলে চাষিরা তামাক চাষে উৎসাহিত হয়। বিক্রিতেও কোনো ঝামলো হয় না।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জানান, তামাক কোম্পানিগুলো তামাক চাষের উপকরণ কৃষকদের বাড়ি বাড়ি সরবরাহ ও তামাক বিক্রি করে নগদ অর্থ দেয়ায় তামাক চাষ কমছে না। কোম্পানির লোক বাড়িতে এসে সার বীজ সব রকম সুবিধা দেয়। তামাক আবাদ করলে চাষিরা কিছু টাকা বেশি পায়।

কৃষক গফুর ইসলাম জানান, তামাক চাষে অতিরিক্ত সার ব্যবহার করার ফলে ভালো ফলন হয়। ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশসহ (বিএটিবি) বিভিন্ন কোম্পানি চাষিদের সহায়তা করে থাকে। আবার বিক্রির ক্ষেত্রে কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না। অথচ, টমেটো বা সবজির আবাদ বেশি হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কিংবা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় দাম পাওয়া যায় না। তাই ভালো বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকলে এবং চাষিদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা না গেলে কৃষকরা অন্য ফসল চাষে আগ্রহী হবেন না।

তামাক চাষের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে জানিয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ গৌতম কুমার রায় বলেন, তামাকের চাষ করতে গিয়ে মাটি নষ্ট হচ্ছে, ফসল হচ্ছে না। বাচ্চাদের লেখাপড়া হচ্ছে না। মেয়ে ও শিশুরা রোগাক্রান্ত হয়েছে। বন উজাড় হচ্ছে, বায়ু দূষণ হচ্ছে।

জেলা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য ও সাফ’র নির্বাহী পরিচালক মীর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গ্রামে তামাক চাষের জন্য কৃষকের পাশাপাশি ঘরের বৌ-ঝিদের (নারী) এ কাজে সহায়তা করতে হয়। তামাক ভাঙার পর জ্বালানো এবং প্রসেসিং করতেও নারীদের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় গর্ভবতী নারীরা এসব কাজ করলে ভুমিষ্ট সন্তানরা বিকলাঙ্গ হয়।

দৌলতপুর উপজেলার একটি অটিজম প্রতিবন্ধ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু সালেহ মাজনুল কবীর পান্না বলেন. তামাকচাষি পরিবারে শিশু, গর্ভবতী এবং দুগ্ধদানকারী মা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকেন। গত এক দশকে এসব মানুষের অনেকে মরণব্যধি ক্যানসারসহ প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের হার বেড়ে গেছে। শুধু দৌলতপুর উপজেলাতেই রয়েছে এক হাজারের বেশি প্রতিবন্ধী। তিনি আরও বলেন, জেলার সবচেয়ে বেশি তামাকের চাষ হয় মিরপুর ও দৌলতপুর উপজেলায়। আর এই দুই উপজেলাতেই সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধীর জন্ম হয়।

তবে কুষ্টিয়া জেলা প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ তামাকের চাষ হয় সে ব্যাপারে সঠিক তথ্য নেই কৃষিবিভাগের কাছে। যা পাওয়া যায় সবই মনগড়া তথ্য বলে অভিযোগ করছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তবে তামাকের পরিবর্তে বিকল্প রবি শস্য চাষে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়ে কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুশান্ত প্রামাণিক সঠিক তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলার ৬টি উপজেলায় মোট ১১ হাজার ৯২৬ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এরমধ্যে খোকসায় ৩ হেক্টর, কুমরাখালীতে ৩ হেক্টর, মিরপুরতে ৭ হাজার ৩৯৫ হেক্টর, ভেড়ামারায় ৮১৫ হেক্টর ও দৌলতপুর উপজেলায় ৩ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। গেলো মৌসুমে কুষ্টিয়া জেলার ৬টি উপজেলায় মোট ১০ হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিলো। এবার তামাকচাষ বেড়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন