ঢাকা | রবিবার
২৫শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মধ্যবিত্ত প্রবীণ নারীর চ্যালেঞ্জ

মধ্যবিত্ত প্রবীণ নারীর চ্যালেঞ্জ

মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হয় পুণ্যির। মায়ের একাকি জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ব্যস্ততা, বিনোদনবিহীন জীবনযুদ্ধ, শুধুমাত্র পূন্যির জন্য। পূণ্যির ভবিষ্যৎ নিয়ে মায়ের কত স্বপ্ন। পূণ্যি কি পারবে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে? যখন যা চেয়েছে মা তাৎক্ষণিক পূণ্যির আব্দার চাহিদা যে কোনোভাবেই হোক পূরণ করেছেন। শৈশব থেকে স্কুলের জন্য রেডি করে স্কুলে আনা নেয়া, প্রাইভেট কোচিং এ নেয়া, বাজার করা, রান্না করা, ঘর গৃহস্থালির কাজকর্ম করা- সব একা হাতেই করে চলেছেন হাসি মুখে। অসুখ হলে ডাক্তার দেখানো, ওষুধ, সেবাযত্ন নিজের হাতেই করতেন। মাঝে মাঝে (মায়ের বোন) খালা মায়ের কাছে এসে থাকতেন সহযোগতিা করতেন। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারতেন না তার নিজের সংসার ছেড়ে।

‘জন্মই নারীর আজন্ম পাপ’ প্রচলিত এই বাক্যটি নারীর অজন্মই চ্যালেঞ্জের কথা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নারীর মানবাধিকার সার্বজনীন মানবাধিকারের অবিচ্ছিন্ন অবিভাজ্য অংশ হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর মানবাধিকার আদৌ সংরক্ষণ করে না। নারীর অনেক স্পর্শকাতর অধিকারকে মানবাধিকার রূপে বিবেচনা করা হয় না। যেমন নারীর প্রজনন অধিকার। প্রায় সব সমাজেই নারীর স্বতন্ত্র আইনগত ও সামাজিক মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেছে। অধিকারহীনদের মধ্যে নারীরা তাই আরো অধিকারহীন। পদে পদে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় নারীকে।

মুসলিম প্রধান দেশে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নারীর পূর্ণ মানবাধিকার মুসলিম শরিয়াহ্ আইনে সংকুচিত হয়ে পড়ে। নারীর মানবাধিকার সনদ ‘সিডও’ স্বাক্ষরকারী ১৫৭টি দেশের মধ্যে ৫২টি দেশই আবার সনদের মূল ধারাগুলি অনুমোদন করেনি। ৩৫টি দেশ ‘সিডও’ সনদ স্বাক্ষরই করেনি। বাংলাদেশেও অধিকাংশ নারীর মানবাধিকার শরিয়াহ্ আইন দ্বারা খর্বিত। বাংলাদেশ সরকার এখনও ‘সিডও’ সনদের প্রাণস্বরূপ ধারা ২ ও ১৬/১(চ) অনুমোদন করেনি।

মোটামুটি স্বাধীনভাবে চলার ক্ষেত্রে শহুরে উচ্চশিক্ষিত নারীর চিত্র কিছুটা ভিন্ন হলেও মধ্যবিত্ত নারী তথা গ্রামীণ নারী স্বাধীনভাবে চলার অধিকারভোগ করে মাত্র ৩০ শতাংশ। বিবাহ বিচ্ছেদ গর্ভধারণ উত্তরাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীরা আজও অধিকারহীন। অধিকারহীনতা নিয়েই মূলত মধ্যবিত্ত ও গ্রামীণ নারীর চ্যালেঞ্জের পথ চলা। এদেশের নারী তার জীবনের ৬০ শতাংশ ব্যয় করে সন্তান ধারন, জন্মদান ও লালন পালনে। চাকরিজীবী নারীর ক্ষেত্রটি আরও কঠিনতর। মধ্যবিত্ত প্রবীণ বয়সে নারীর চলার ক্ষেত্রটি ভয়ানক বেশি চ্যালেঞ্জের।

আমাদের সমাজের পারিপার্শিক অবস্থা থেকে সংগৃহিত মধ্যবিত্ত প্রবীণ নারীর চ্যালেঞ্জের একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরছি:

পূন্যি বড় হয়ে গেছে….। সমাজচিত্র মূল্যবোধ জীবনাচরণ ধনী-দরিদ্রের জীবন জীবিকা, দারিদ্রের কষাঘাত, অবহেলা ঘৃণা, সহযোগিতা, সহমর্মীতা, ভালোবাসা, স্নেহ মমতা দেখতে দেখতে অনেক কিছুই বুঝতে, অনুভব করতে শিখে গেছে। পূন্যি সুন্দর ছবি আঁকে। শৈল্পিক চিত্র অংকনে ফুটিয়ে তোলে মনের অনুভব উপলদ্ধিগুলিকে। রং তুলিতে মনের মাধুরী মিশিয়ে শৈশব থেকে আঁকাআঁকির মধ্যে দিয়ে তাঁর স্পর্শকাতর চাপা, কষ্ট, ইচ্ছা, অনুভূতির প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।

স্নেহময়ী মা ওকে ভীষণ ভালোবাসে। পূণ্যি যে মায়ের প্রাণপাখী। সে তা ভালোভাবে অনুভব করে। মাঝে মাঝে ওর খুব মন খারাপ হয়। মায়ের একাকি অক্লান্ত পরিশ্রম আর বিরামহীন ব্যস্ততা দেখে। নিজের প্রতি যত্ন নেয়ার সময় পায়না মা। বিনোদন বলে কিছু নেই তার। একমাত্র আমিই তার স্বপ্ন সাধনা। মা ওকে ভীষণ ভালবাসে। ওর আঁকা ছবিতে তা সপ্রতিভ ফুটে উঠে। বেশির ভাগ ছবিই সমাজচিত্র আর মাকে নিয়ে। স্বপ্নে ধরা, কল্পিত বাবাকে নিয়ে। সমাজের নানা বিষয় নিয়ে একেকটা চিত্র একেক রকম কথা বলে। মাকে নিয়ে কত ভাবনা কত কথা কত ব্যথা ওর রং তুলিতে শিল্পকর্মে তা ফুটে আছে।

মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হয় পুণ্যির। মায়ের একাকি জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ব্যস্ততা, বিনোদনবিহীন জীবনযুদ্ধ, শুধুমাত্র পূন্যির জন্য। পূণ্যির ভবিষ্যৎ নিয়ে মায়ের কত স্বপ্ন। পূণ্যি কি পারবে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে? যখন যা চেয়েছে মা তাৎক্ষণিক পূণ্যির আব্দার চাহিদা যে কোনোভাবেই হোক পূরণ করেছেন। শৈশব থেকে স্কুলের জন্য রেডি করে স্কুলে আনা নেয়া, প্রাইভেট কোচিং এ নেয়া, বাজার করা, রান্না করা, ঘর গৃহস্থালির কাজকর্ম করা- সব একা হাতেই করে চলেছেন হাসি মুখে। অসুখ হলে ডাক্তার দেখানো, ওষুধ, সেবাযত্ন নিজের হাতেই করতেন। মাঝে মাঝে (মায়ের বোন) খালা মায়ের কাছে এসে থাকতেন সহযোগতিা করতেন। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারতেন না তার নিজের সংসার ছেড়ে।

খালা পুণ্যিকে খুব আদর করে। মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ক্লান্ত অবসন্ন অবয়ব অযত্নে মলিন চেহারা দেখে পূণ্যি আনমনা হয়ে কল্পনার জগতে চলে যায়। মায়ের কাজে টুকটাক সাহায্য করে। কিন্তু মা তাকে করতে দিতে চায় না। কাজের নেশা হলে নাকি পড়াতে মন বসবে না। তবু নিজের কাজটুকু নিজে করে ফেলি। মায়ের বয়স হয়েছে। শরীর ক্লান্ত হয়। শুধু মনের জোর নিয়ে চলেন। সবার বাবা আছে আমার বাবা নেই। অকস্মাৎ প্লেন দুর্ঘটনায় সাংঘাতিকভাবে আহত হয়ে ৬ বছর বিছানায় পড়েছিলেন। মায়ের ডাক্তারের পরামর্শ চিকিৎসায় শত চেষ্টা করেও তাকে সুস্থ করতে পারেননি। মা আমার বাবা মায়ের সব দায়িত্ব একাই পালন করে চলেছেন।

কিন্ডার গার্টেনে চাকরি করে স্বল্প আয়ে কাজের লোক ছাড়াই নিজে পরিশ্রম করে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু আমাকে মানুষ করার জন্য। তার স্বপ্ন পূরণের জন্য। আমি স্কুল কলেজ শেষ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করতে যাচ্ছি। মায়ের কত প্রস্তুতি কত পরিকল্পনা। রাতে বিছানায় শুয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে। আমাকে নিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলেন। কত কিছু বুঝিয়ে দেন সামনে পথে এগিয়ে চলার জন্য।

মায়ের গানের গলা খুব সুন্দর। আগে গান গাইতেন। এখন বন্ধ! শুধু ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে মিহি সুরে আমাকে গান শোনান.. গান শুনে শুনে ঘুমিয়ে পড়ি।

আমার বাবা মি. রাহমান ছিলেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। কাতারে চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন দাম্মাম হাসপাতালে টেকনিক্যাল অফিসার পদে। আমার জন্মের সংবাদ পেয়ে আমাকে দেখার জন্য দেশে ফেরার পথেই প্লেন দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর থেকে আমাদের পরিবারিক জীবন অন্ধকারে ছেয়ে গেল।

লেখক: কবি কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার ও গল্পকার। বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার। সাবেক উপপরিচালক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন