চলে গেলেন সোনায় মোড়ানো, সোনালি কণ্ঠের মানুষ প্রিয় শিল্পী বাপ্পি লাহিড়ী। আমার যৌবনকালে তাঁর কণ্ঠ আমাকে করেছিল মোহচ্ছন্ন। বাংলা গানের একটা ভিন্ন ধারা তৈরি করেছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যখন মন খারাপ থাকতো তখন ছোট টেপ রেকর্ডারে-ক্যাসেট বাজিয়ে প্রায়ই শুনতাম মান্নাদে-র গান। এক সময় সেই জায়গা দখল করে বাপ্পি লাহিড়ি। রুমমেট মাহমুদ পাশের রুমের রতন সাবু সবাই মিলে জোরে সাউন্ড দিয়ে শুনতাম তার জাদুময় কণ্ঠের গান ‘আমি বিশ্বাস করি সংগীতে বা সোনার অক্ষরে লেখা ভুলে যাওয়া নাম’। প্রেম করার সময় এই সোনার অক্ষরে লেখা গানটির হিন্দি ভার্সন ‘তুমহারা পেয়ার চাহিয়ে মুঝে জিনে কে লিয়ে’ গানটি মনে গেঁথে যায়। মিনু-র সেটি হয়তো মনে নেই বা আছে। তারপর আমাদের দুজনারই ভালোলাগার গান- ‘চিরদিনই তুমি যে আমার যুগে যুগে আমি তোমারি…’।
আমার সংগীত জীবনে তাঁর সঙ্গে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল একটি অনুষ্ঠানে কোলকাতায়। নাম ঠিকানায় কার্ড রেখেছিলেন কিন্তু আর যোগাযোগ হয়নি। সেটাই স্বাভাবিক। আমার অবচেতন মনে সেই আশি-একাশি থেকে একটা নীরব ভালোবাসা জন্মেছিল তাঁর প্রতি। তাঁর গানের কম্পোজিশনের প্রতি। আমার মনে হয় বাংলা গান কম্পোজিশনে এতো ভেরিয়েশন তাঁর আগে কেউ দেখাতে পারেননি। এটা অবশ্য আমার একান্ত নিজের ধারণা। একটা কথা বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার না করলেই নয়। ১৯৮৪-তে আমার গানের একটি ক্যাসেট বের করে কনকর্ড। তার মধ্যে একটা গান সংযোজিত হয় ‘তারার আলো নিভে গেল’ কাজী জামালের লেখা গানটি মর্ডান মিউজিক ডেভলপমেন্ট ফেরদৌস ভাইয়ের স্টুডিও-তে রেকডিং-এ যাঁরা যন্ত্র বাজিয়ে ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিল পান্না, লাবু, রকেট, পিয়ারু, শাহীন-। বলেছিলাম বাপ্পি-দার গানের মতো কম্পোজ হতে হবে। হয়েছিল-ও তাই।
রেকডিং শেষে ফেরদৌস ভাই শুনে বলেছিলেন ‘কিরে এটা তো বাপ্পির গানের কপি মনে হচ্ছে’। আসলে সত্যি কথা বলতে গেলে কি, হয়েছিল-ও তাই। তাঁর সুর কম্পোজিশন কণ্ঠ সবই ভিন্ন। আর এই ভিন্নতাই আমাকে করেছে অনুপ্রাণিত। সৃষ্টি করেছে তাঁর প্রতি বুক ভরা ভালোবাসা। তাঁর চলে যাওয়া খবরটি আমাকে প্রথম জানায় আমার শিল্পী মেয়ে ড. সঞ্চারী। আজ যখন তাঁকে নিয়ে লিখছি তখন ডিজিটাল কনভার্সনে যত্নে রাখা আমার সেই গানটি বেজে চলছে আমার পিসি-তে, মনের এককোনে চিনচিন করছে প্রিয় মানুষ, প্রিয় শিল্পীর প্রতি ভালোবাসার কষ্ট।
গানটির কথা ‘তারার আলো নিভে গেল, দৃষ্টিতে আলো জ্বালো না। জোনাক জ্বলা সেই রাত ফিরে কি পাব না। শুকতারা জ্বলে নিভে গেল। জোনাকীরা নিশিরাতে পথ হারালো শুকতারার মতো মনের আকাশে জ্বলে থাকা বাপ্পি-দার প্রস্থানে মনটা ভারী হয়ে গেল। মনে হচ্ছে সব গানের পাখি পথ হারিয়ে ফেলছে। আঁধারে ঘুরে ফেরা জোনাকিরা ও পথ হারিয়ে ফেলছে।
বাপ্পি নামের অর্থ হলো-বাপি অর্থাৎ পিতা বা বাবা। ভারতের জলপাইগুড়ির শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবারে তাঁর জন্ম ১৯৫২-র ২৭ নভেম্বর। তাঁর আসল নাম অলোকেশ বারী লাহিড়ী। মা সংগীতজ্ঞ বাঁশরী লাহিড়ী ও বাবা শিল্পী অপরেশ লাহিড়ীর ঘরে তিনি ছিলেন একমাত্র সন্তান। সম্পর্কে মামা কিশোর কুমারের কণ্ঠ থেকে অনুপ্রানিত হওয়া এই কালজয়ী শিল্পী মাত্র ১৯ বছর বয়সে দাদু নামক বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করেন সালটা ছিল ১৯৭২। ১৯৭৩ এ হিন্দি ভাষায় নির্মিত নানহা শিকারী ছবির জন্য তিনি প্রথম গান রচনা ও প্লেব্যাক করেন। আশির দশকে তার ডিসকো ড্যান্সার ছবির গান শোনেন নি এরকম একজন বাঙালি-ও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আসলে তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রে ভারতীয় ধাঁচে ডিস্কো সংগীত পরিবেশন করেছেন যা তাঁকে সব বয়সী দর্শক শ্রোতার মনে একটা ভিন্ন আসন তৈরি করে দেয়। তাঁর গাওয়া গান ‘বোম্বে সে আয়া মেরা দোস্ত, ইয়াদ আ রাহা হ্যায়’ অথবা ‘দিল মে হে তুম’ এখনো শুনলে প্রেমিক মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। একজন গীতিকার হিসেবে তাঁর রচিত গান এক কথায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়। কিশোর কুমারের গাওয়া ‘চালতে চালতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা’ বা ‘কে পাগ ঘুঙ্গরাও বান্ধ মিরা নাচি থি’ আজো সকল শ্রোতার মন জয় করে আছে। মনে পড়ে একবার নিউইর্য়ক ভ্রমণের সময় রাত প্রায় তিনটা আমি ও আমার বন্ধু সালাউদ্দিন যখন হার্ডসন রিভারের ওপর দিয়ে লং ড্রাইভে যাচ্ছি তখন দুরে সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে তার লেখা সেই অমর গান ‘চালতে চালতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রাখনা’।
বাংলা ভাষা ও বাংলাগানের প্রতি ছিল তাঁর অগাথ ভালোবাসা ও প্রেম। তাই তিনি সময় পেলেই হয়তো ছুটে আসতেন বাংলাদেশে। বাংলা গানে অত্যন্ত দরদ দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে ঢেলে দিতেন সুর। তাঁর সংগীত পরিচালনায় নির্মিত অমর সঙ্গী, আশা ভালোবাসা অথবা অমর প্রেম ছবির গানগুলিতে তা স্পষ্ট হয়েছে। স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস তাঁকে পরিচালিত করে সুরের ভুবনে। তিনি বিশ্বাস করতেন সেই মহাজাগতিক সৃষ্টিকর্তা যদি তাঁর কণ্ঠে সুর না দিতেন তাঁর মাস্তিষ্কে সুরের সম্ভার সাজিয়ে না দিতেন তাহলে তাঁর পক্ষে বাপ্পি হয়ে গড়ে উঠা সম্ভব হতো না। আমার সঙ্গে যেদিন প্রথম দেখা তাঁর, তাঁকে বলেছিলাম, আমি কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস জুড়ে আপনার সেই গানটি কয়েক শতবার গেয়েছি, ‘আমি বিশ্বাস করি সংগীতে’, প্রতুত্তরে তিনি হেসেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ইয়ে সাচ বাত হ্যায়-ফিরসে গাও’ আরে ভাই গাওনা, ‘আমি গেয়েছিলাম- আমি জন্মে যখন প্রথম কেঁদেছি, পেয়েছি সুরের ছোঁয়া, আমার জীবনের প্রথম ছন্দ মা-র হাসি থেকে নেয়া, মা বলে যখন প্রথম ডেকেছি, পেয়েছি বাণী আর সারগাম, আমি বিশ্বাস করি সংগীতে তাই বিশ্বাস করি ভগবান’।
প্রিয় বাপ্পি-দা আপনি হয়তো স্বশরীরে এই ইহধাম ত্যাগ করে তাঁর স্নিগ্ধ ছায়ায় চির আশ্রয়ে চলে গেলেন, তাই বলে আপনার সুর আপনার সৃষ্টি কিন্তু থেমে রইলো না। এই বিশাল সংগীত ভুবনে সকল শিল্পী সুরকার গীতিকার অগণিত শ্রোতার মনের মনিকোঠায় আপনি চির জাগ্রত থাকবেন এটা আমাদের বিশ্বাস। মনের গোপন কোঠর থেকে জীবনের কোনো কষ্ট বা আনন্দ ক্ষণে বিশ্বাস ও ভালোবাসার দোলায় দুলে হয়তো ব্যক্ত হবে ‘তুমহারা পেয়ার চাহিয়ে মুঝে জিনে কে লিয়ে’। আর আমরা যাঁরা শিল্পী গান করি তাদের কণ্ঠে চিরদিন গীত হবে, ‘আমি বিশ্বাস করি সংগীতে তাই বিশ্বাস করি ভগবান’। বিদায় বাপ্পি লাহিড়ী।
লেখক: কণ্ঠশিল্পী ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।
© 2025 Dainikanandabazar.com
Developed by: ❤ Contriver IT