সোশ্যাল মিডিয়া, সরাসরি বলা যায় ফেসবুকে ইদানিং যে ধরনের পোস্ট বা ছবি আপলোড দেখা যায় এবং তাদের বন্ধু-বান্ধব বা অনুসারীরা যে মন্তব্য করেন তা কতোটা যুক্তিযুক্ত? তা কি একবার ভেবে দেখা দরকার নয়? এক মুহূর্তের কিছু দৃষ্টিনন্দন ছবি বা পোস্ট সারা সময় জুড়ে টাইমলাইনে পরিস্ফুট হয়ে থাকা মানেই কিন্তু জীবনটা তেমন নয়! অনেকেই যারা নিজেদের বিজ্ঞ ও সুশীল ভাবেন, তারাও অনেকেই ফেসবুক ব্যবহারে একেবারেই নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করছেন না। ফেসবুক পর্দায় চোখ রাখলে দেখা যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে নবীণদের চেয়ে প্রবীণরাই বরং এর অপব্যাবহার করছেন বেশি।
সম্প্রতি চোখে পড়া কিছু মন্তব্যর কথাই ধরা যাক। অবসর জীবনে যাওয়া এক ভদ্রলোক আরেক ভদ্রমহিলার একক ছবিতে মন্তব্য করেছেন, ‘আমি তো দেবী দেখছি, দেবীর মতোই লাগছে’। আরেক মন্তব্যে লিখেছেন, ‘নায়িকা’র মতো দেখাচ্ছে, নায়িকা কি কেবল নায়ক আর ভিলেনদের তুষ্ট করলেই চলবে! ভক্তদেরও তো কিছু দিতে হয়’! কিংবা বুড়ো হয়ে গেছি বলে কি সাধ-আহ্লাদ থাকতে নেই’!
কোনো সামাজিক মাধ্যমে এ জাতীয় মন্তব্য কতোটুকু শোভনীয়, তা চিন্তা করবার বিষয় বৈকি! তার ওপর যদি অনুসরণ ও শ্রদ্ধাযোগ্য ব্যক্তি এ জাতীয় মন্তব্য করার আগে না ভাবেন তাহলে অনুজ ও নবীণদের সমালোচনা করার কোনো অধিকার থাকে কি তাদের! কেননা, সামাজিক মাধ্যমে জানার উপায় নেই কে স্বজন’ কে ‘বান্ধব’ আর কে-ই বা শুধুই ভার্চুয়ালি পরিচিত। তার ওপর মধ্যরাত কিংবা ভোররাত কিনা সে সময় জ্ঞানটুকু পর্যন্ত খেয়াল রাখছেন না। এসব মন্তব্য সকলের চোখে পড়ছে এবং যে যার মতো ধারণা করে নিচ্ছে।
এছাড়া ছবি পোস্ট করার ব্যাপারে বেশির ভাগ মধ্যবয়সী থেকে পড়ন্ত বয়সী রমণীগণ তাদের সাজসজ্জা, গয়না-শাড়ি, মেকআপ, ভাব-ভঙ্গিমা, খাবার পরিবেশন নিয়ে যেসব পোস্ট ক্ষণে ক্ষণে দিয়ে থাকেন তা মূলত স্নায়ুবৈকল্যের প্রাথমিক লক্ষ্মণই বলা চলে। এখানে ক্ষণে ক্ষণে শব্দটা বিশেষভাবে লক্ষ্য করা দরকার। এইসব অযোচিত প্রদর্শনে তাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা তো জাগায়ই না বরং কমায়। আগে খালা-মামী-চাচীদের দেখলে মমতা ও শ্রদ্ধায় হৃদয় ভরে যেতো। এখন তাদের এই প্রকাশভঙ্গী কি এতটুকু ভক্তি জাগায় পরবর্তী প্রজন্মের চোখে! এই প্রকাশের মানসিক তৃপ্তি কতোখানি একমাত্র তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন। তবে সেটা যে তাদের হতাশা ও উদ্বোগ-এর বহিঃপ্রকাশ তা গবেষণাই বলে দেয়।
সম্প্রতি রেডিওলজিক্যাল সোসাইটি অফ নর্থ আমেরিকা কনফারেন্সে একদল গবেষক জানান, এমআরআই ও এমআরএসের মাধ্যমে তারা দেখেছেন স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটে আসক্ত মানুষের মস্তিষ্কে গামা অ্যামাইনো বিউটারিক অ্যাসিড বা গাবা এবং গ্লুটামেট-গ্লুটামাইন বা জিএলএক্সের অনুপাত স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়িয়ে দেয়। যা মস্তিষ্কের তরঙ্গ প্রবাহের গতিকে অনেক কমিয়ে দেয়। অনুপাতের তুলনায় বেশি হওয়ায় গাবা ও জিএলএক্স বাড়ায় হতাশা ও উদ্বেগ। এর ফলে বাড়ে কাজের প্রতি অনীহা, ঝিমুনি ও স্নায়ুবৈকল্য।
কৌতুহল হলো বড়োরা, যারা আমাদের অগ্রজ, তাদেরেই বরং সারাক্ষণ স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটে বন্দী থাকতে দেখি। আজকাল কোনো আড্ডায় কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে দেখা যায় ছোটদের চেয়ে বড়োরাও স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট তথা ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বেশি। শুধু তাই নয় মুখোমুখি আড্ডার চেয়ে তারা ভার্চুয়াল বন্ধুত্বকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। অনেক সময় সামনে থাকা মানুষটিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে সময় কাটান ভার্চুয়াল বন্ধুদের নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে।
উপদেশ বা পরামর্শই কেবল মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাশীল হতে অনুপ্রাণিত করে না। কোনো মত পার্থক্য বা গরমিল হলেই সরাসরি অন্যদের দোষারোপ করার মানসিকতাও পরিহার করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অগ্রজদের ভুমিকা অনস্বীকার্য। তারা নিজেরা নিজেদের কাজকর্মে ও আচরণে তার প্রতিফলন না দেখালে নবীণরা কী করে উৎসাহিত হবে। পরামর্শের ক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠ বা অগ্রজগণ প্রায়ই উপদেশ দিয়ে থাকেন- মানুষের মনটা ডাস্টবিন নয়, তাই সেখানে রাগ, ঘৃণা, বিদ্বেষ জমা করে রাখতে নেই।
মন হলো কেবলই ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতার জন্য। অথচ দেখা গেলো কোনো এক ঘটনায় বড়োদের সঙ্গে কোনো ব্যাপারে মনোমালিন্য হলে তারাই রাগ, ঘৃণা, বিদ্বেষ দিনের পর দিন জমা করে রাখেন। খুব সহজে ক্ষমা করতে পারেন না। এই যে, দ্বৈতআচরণ সেটা বুঝেও অনুজ তথা নবীণরা কিছু বলতে পারে না। পরিবেশ আরো প্রতিকূল অবস্থায় চলে যাওয়ার আশঙ্কায়। এ ক্ষেত্রে অগ্রজদের বোঝাবার দায়িত্ব নেবে কে!
সমাজে ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য বজায় রাখতে অগ্রজ ও অনুজ উভয়ের ভূমিকা সমান। এ ব্যাপারে দু-পক্ষকেই খেয়াল রাখতে হবে। সম্মান ও শ্রদ্ধা পেতে ব্লেম-গেম নয় বরং পারস্পরিক চিন্তা ও আচরণের পরিশীলতাই যথেষ্ট। প্রাসঙ্গিক ভাবেই গাবা ও জিএলএক্স প্রবীণদের মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলে। হতাশা, উদ্বোগ, স্নায়ুবৈকল্য তাদেরও ক্ষতি করছে অতিমাত্রায় স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটে বন্দী থাকায়।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আজকাল খুব প্রচারণা ও প্রকাশনা দেখি। অথচ নিয়মিত ব্যায়াম কিংবা সময়মতো ঘুমোতে যাওয়া, নিয়মতান্ত্রিক চলাফেরা, পারিবারিক আড্ডায় ছোটদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রবণতা, এসবের দায়ভার অগ্রজেরা নিতে চান না। বিশেষ করে অগ্রজেরা বা পরিবারের প্রবীণেরা ছবি পোজ বা ফেসবুক পোস্টে সময় ক্ষেপণ না করে যদি এই দায়িত্বটুকু নেয়ার চিন্তা করতেন তাহলে বোধহয় উভয়পক্ষই লাভবান হতো। নিজেকে প্রকাশ ও প্রচার করার মানসিকতার পরিবর্তে বরং অনুজদের পথপ্রদর্শক হওয়ার বিষয়টা ভেবে দেখার সময় এখন। অহেতুক ভার্চুয়াল মন্তব্যে সময় নষ্ট না করে সৃজনশীল কিছু ভাবার কথা।
আজকাল অগ্রজ তথা প্রবীণরা নিজেরাই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করার ব্যাপারে পরিশীলতা মেনে চলেন না। যে সহনশীলতা আমরা আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের মাঝে দেখেছি তা বর্তমান বয়োজ্যেষ্ঠদের আচরণে সেভাবে বিরাজমান নেই। তাছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম-খাবার, সময়মতো ঘুম ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই করা দরকার। এতে করে তাদেরও সৃজনশীলতা বাড়বে, বাড়াবে সহনশীলতা। শ্লথ হবে সামাজিক মাধ্যমের অপব্যাবহার আর চর্চিত হবে শ্রদ্ধাবোধ।
আনন্দবাজার/শহক