ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উত্তাল একাত্তরের অশান্ত প্রহরগুলি

আলমগীর ফুপাদের ‘খাটুরিয়া’ সে সময় শিক্ষাসমৃদ্ধ প্রসিদ্ধ উন্নত গ্রাম। শরণার্থী শিবির হয়ে উঠলো ফুপাজির বাড়িটা। সন্ধ্যাগুলোতে চুপি চুপি আলো নিভিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর শোনার কি অসীম আগ্রহ উৎকণ্ঠায় সকলে ঘিরে বসতাম রেডিওর চার ধারে। খুব সন্তর্পণে। ছোট অবুঝ বাচ্চারাও কি অদ্ভুতভাবে ধৈর্য নিয়ে চুপসে আছে। কোনো আদর আব্দার তো দূরের কথা খিদে পেলেও খাওয়ার কথা বলে না।

ফুপার বাড়িতে কাজের লোকজনের অভাব নাই। প্রতি বেলা খাসি জবাই হতো। বড় বড় ডেকে রান্না খাওয়ার তুমুল ব্যবস্থা। অথচ ভয় আশংকায় কেউ তেমন খেতে পারতাম না। রাত জেগে জেগে শব্দহীন নির্ঘুম বসে থাকতাম। অনিশ্চিত প্রহর গুনছি। আব্বা-আম্মাকে একা ফেলে এসে বুক কাঁপতো। ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধে.. গোলাগুলির শব্দ শুনলে আঁতকে উঠতাম। অনিদ্রায় শরীর খারাপ হতে লাগলো।

ক’দিন পরেই খবর এলো আব্বাকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা তিন ভাইয়ের খবর জানার জন্য। চাচা এলেন খবর নিতে। আমাদের আরো দূরে গ্রামে যেতে হবে চাচার শ্বশুরবাড়ি “দেওয়ানগঞ্জ” হলদিবাড়ী বর্ডারের কাছে। দিনে দিনে অবস্থা বেশি খারাপ অবস্থায় অবস্থার দিকে..। এমন অবস্থায় যেন ভারতে চলে যাওয়া যায়। কারণ আকাশ পথেও গোলাগুলি। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে পাক-সেনারা। যুবক যুবতিদের দেখতে পেলেই সর্বনাশ!
এবার আমাদের অন্য একযাত্রায় পাড়ি দিতে হবে। চাচা আমাদের নিয়ে গেলেন। পরদিন ভোরে আমরা রওনা হলাম তিনটি গরুর গাড়িতে পাড়ার প্রতিবেশীসহ মোট ১৮ জন। দুশ্চিন্তায় কষ্টের প্রহর গড়িয়ে যেতে থাকে। আতঙ্কে ভয়ে কান্নার অশ্রু শুকিয়ে গেছে। কথা বেরুতে চায় না।

দাদি, বাবা, মাকে রেখে আমরা কোথায় যাচ্ছি। অনিশ্চিত ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ ভেবে বুকটা ভেঙে চুরমার হতে চায়। রাস্তায় দেখছি ব্যাগ বোজকা পিঠে করে, কোলে শিশু, মানুষের ঢল নেমেছে অজানার গন্তেব্যে। কিছু দূর গিয়ে কাফেলার সারিতে দেখি এক জোয়ান একদিকে বৃদ্ধ বাবা অন্য দিকে মাকে ঘাড়ে ভার ভাংকুয়ায় করে এগিয়ে চলছে। কি অসহায় দুর্বিসহ সময়।

আর কিছুদূর গিয়ে চোখে পড়ল হৃদয় বিদারক আর এক দৃশ্য। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতর। স্বামী নিরূপায় রাস্তার কিনারে স্ত্রীর পাশে। আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। গরুর গাড়ি থামিয়ে ওদের সাহায্য করতে নেমে গেলেন..চারদিক নির্জন ধূধূ..মানবহীন শুন্যগ্রাম মোতালেব চৌধুরী, জনশূন্য একটি বাড়িতে খোলা রান্না ঘরে দম্পতিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করলেন।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন