ঢাকা | শুক্রবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আতঙ্কের এক নাম সিন্ডিকেট

ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট নেতিবাচক আর আতঙ্কের এক নাম দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ৷এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ শুধু বাজারে পণ্যের দামের কারসাজিতেই সীমাবদ্ধ নয় ৷ এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে গোটা দেশ ৷ অর্থনীতি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেটের আলাদা একটি গুরুত্ব আছে ৷একটি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে যখন কোনো উদ্যোগ বিনিয়োগ বা লেনদেন সম্ভব হয় না, তখন অনেকে মিলে সেটি করলে তাকে সিন্ডিকেট হিসেবে অভিহিত করা হয় ৷

আর্থিক খাতে বিশেষ করে ব্যাংকিংয়েও সিন্ডিকেট গুরুত্বপূর্ণ ৷ বড় আকারের কোনো ঋণের ক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাংক মিলে যখন তার জোগান দেয়, তখন সেটি ‘সিন্ডিকেটেড লোন’ হিসেবে বিবেচিত হয় ৷ কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট এখন দেশের সাধারণ মানুষের কাছে নেতিবাচক আর আতঙ্কের এক শব্দে পরিণত হয়েছে, যা দিয়ে তারা ব্যবসায়ীদের এক ধরনের মেকানিজমকে বোঝেন, যার মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে ভোক্তাদের ঠকানোর যাবতীয় আয়োজন করা হয় ৷

দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবশালী কয়েকটি সিন্ডিকেট রয়েছে, যাদের কাছে অনেক সময় সরকারও অসহায় হয়ে পড়ে । বর্তমানে পেয়াজও এই একই সিন্ডিকেটের শিকার । প্রতি বছর রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখার সরকারি উদ্যোগ-আয়োজন সবকিছু এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ভণ্ডুল হয়ে যায় । আইন-আদালত ঘিরেও রয়েছে আরেক সিন্ডিকেট ।

ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিল করতে সবকিছুই করতে পারে সিন্ডিকেট। রাজনৈতিক দলের মনোনয়নপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি হতে হলেও সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ অপরিহার্য । মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীদের মধ্যে যেমন আলাদা সিন্ডিকেট আছে তেমনি সংসদ সদস্যদের মধ্যেও আছে আলাদা মত-পথের সিন্ডিকেট । জেলা পর্যায়েও সংসদ সদস্যরা পৃথক সিন্ডিকেটে বিভক্ত। মানব পাচার, জনশক্তি রপ্তানি, এমনকি হজে লোক পাঠানোর বিষয়ও নিয়ন্ত্রণ করছে শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট । সিন্ডিকেট সদস্যদের প্রভাবেই দেশজুড়ে দখল-বেদখল-পাল্টা দখলের সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। ক্ষমতার প্রভাব, দলীয় পরিচয়, অস্ত্রের বল আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে চলে দখলবাজির দাপুটে কারবার। সরকারি সম্পত্তি, টেন্ডার থেকে শুরু করে পেশাজীবীদের ক্লাব-সংগঠনও দখলবাজির হাত থেকে রেহাই পায় না ।

জনগণের কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে ব্যাংক থেকে ৷ সেই টাকা উদ্ধার করতে পারছে না সরকার ৷ এই ঋণখেলাপিদের সিন্ডিকেটটি এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরে থাক উল্টো অর্থ ফেরত দিতে নানা ছাড় দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে৷ তা-ও টাকা উদ্ধার করা যাচ্ছে না তাদের কাছ থেকে। খেলাপি ঋণের টাকা আদায় করা যায় না, অথচ বছর বছর বাজেট থেকে জনগণের করের টাকায় ব্যাংকের তারল্য সংকট মেটানো হয় ৷

অন্যদিকে প্রতি বছর রোজা এলেই এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়িদের মেকানিজম টের পাওয়া যায় ৷ ব্যবসায়ী নেতারা রোজা শুরুর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে বৈঠক করেন ৷ ঘোষণা দেন, চাহিদার অতিরিক্ত পণ্যের মজুদ থাকায় কোনো পণ্যেরই দাম বাড়বে না ৷ বিগলিত হয়ে বাণিজ্য মন্ত্রীও তখন মানুষকে আশ্বাসের বাণী শোনান৷ তারপর বাজারে গিয়ে ভোক্তারা বোকা হতে শুরু করেন ৷ একই চিত্রনাট্যের মঞ্চায়ন চলছে বছরের পর বছর ৷ সাধারণ মানুষের কাছেও বিষয়টি নিয়তির মতো হয়ে গেছে ৷ একদম প্রথম দিন থেকে ঈদে বাড়ি যাওয়া এবং আসা পর্যন্ত প্রত্যেকটা ব্যপারে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় ৷ রাস্তা-ঘাটে, দোকানে, বাসে, লঞ্চে মানুষ টাকা উপার্জনের জন্য জানোয়ারের মতো আচরণ করে ৷ এ যেন এক অত্যাচারের মহোৎসব ৷

এমনকি ব্যবসায়িরা গরিবের হক কোরবানির চামড়াকেও সিন্ডিকেটের আওতায় আনতে বাদ দেয়নি । চামড়া দিয়ে যেসব পণ্য তৈরি করা হয়, তার প্রত্যেকটির মূল্য প্রতি বছর বেড়েই চলছে। বিশেষ করে, জুতা ও চামড়ার ব্যাগ, বেল্ট ও জ্যাকেটের দাম বর্তমানে আকাশচুম্বী। একজোড়া চামড়ার জুতার দাম ছয় বছর আগে সাত-আট শ’ ছিল, তা বেড়ে বর্তমানে দুই হাজার টাকারও বেশি । তাহলে চামড়ার দাম কমবে কেন? অনেক ট্যানারি মালিক অর্থ সঙ্কটের কথা বলে থাকেন । কিন্তু সরকারি চার ব্যাংক এ খাতে ৬০০ কোটি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে থাকে। তা ছাড়া মওসুমি ব্যবসায়ীরা এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন । এত টাকার জোগানের পরও অর্থ সঙ্কট থাকার কোনো কারণ থাকতে পারে না ।

সত্যিকার অর্থে, সিন্ডিকেট ইচ্ছে করেই এ ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি করে নিজ স্বার্থে । দুস্থ মানুষগুলো আমাদের সম্পদের ওপর ন্যায়সঙ্গত অধিকার রাখে। আমরা যারা কোরবানি দিয়ে কম দামে চামড়া বিক্রি করি, তারা কি গরিবদের হক নষ্ট করছি না? অনেকেই বলবেন, বিক্রিমূল্য যা পেয়েছি তা বিলিয়ে দিয়েছি । কিন্তু মনে রাখা চাই, সিন্ডিকেটের ন্যায় কার্যক্রমের প্রতিবাদ না করে, কম দামে চামড়া বিক্রি করা আর গরিবদের হক নষ্ট করা একই সূত্রে গাঁথা। তাই সবাই মিলে অবিলম্বে এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়িদের প্রতিকার করতে হবে । তাহলেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সুবিচার।

সংবাদটি শেয়ার করুন