কবরী বিশ্বাস অপু
আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজ-সতেজ ক্যানভাস ও শুভ্র-সুনীল পূব আকাশে আরক্তিম সূর্যোদয়,সে আমার দেশ,আমার আজন্ম লালিত স্বপ্নের সুবর্ণ বাংলাদেশ।এই দেশ তথা স্বপ্নের বাংলাদেশই আমার কাছে নির্ভীক স্বাধীনতার এক অনন্য উদাহরণ।অথচ,এই পূণ্য ভূমির উপর একদিন হানা দিয়েছিল মানুষরূপী পাকিস্তানি দানবরা।
অতঃপর ১৯৭১ সালের ১৬ডিসেম্বর, ২৪বছরের পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসনের হাত থেকে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। বিশ্ব মানচিত্রে উন্মোচিত হয় একটি স্বাধীন পতাকা, একটি রক্তিম মানচিত্র। এ বিজয়, এ অর্জন কারো দয়ার দানে পাওয়া নয়।তিরিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে, এক সাগর রক্তের খুব চড়া দামে কেনা আমাদের স্বাধীনতা। সুদীর্ঘ নয় মাস আর সাগরসম রক্তের বদৌলতে অর্জিত স্বাধীনতার মূলমন্ত্র আমার কাছে যেকোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশের থেকেও ভিন্নতর, অহংকার ও গৌরবের। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোটি বাঙালির নিরেট আবেগ-ত্যাগ-সংগ্রাম-প্রতীক্ষা আর প্রার্থনার ফসল এই সুবর্ণ স্বাধীনতা। তাই আমার কাছে সবার আগে স্বাধীনতা মানে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী, সমৃদ্ধশালী, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক এক বাংলাদেশ।
মুজিব বর্ষে যখন লিখছি আমার স্বাধীনতার কথা, তখন বাংলাদেশ উদযাপন করতে চলেছে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে স্বপ্নের স্বদেশ নিয়ে নিজের ভাবনা প্রকাশ করাই আমার কাছে তারুণ্যের স্বাধীনতা। যদিও স্বাধীনতা শব্দটি ব্যাপক ও বিস্তৃত অর্থ বহন করে। ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-স্থান,দেশ-জাতি-সংস্কৃতির নিরিখে স্বাধীনতার সংজ্ঞা আলাদা ও ভিন্নতর।তবে স্বাধীনতা মানে আমরা স্বভাবতই যেটা মনে করি তা হলো-স্ব অধীনতা অর্থাৎ নিজের অধীনে চলা, নিজের বিবেক ও ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। আবার এই স্বাধীনতা মানে লাগামহীন আচরণ নয় বরং রুচিশীল ও মার্জিত ব্যবহার।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথ মসৃণ ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ নয়। মুক্তিযুদ্ধ মানে ন্যায্য অধিকার ও সংস্কৃতি রক্ষার যুদ্ধ। ২৪ বছরের শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ।সর্বোপরি ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বাঙালি ইতিহাস রক্ষার জন্য যুদ্ধ, মানচিত্র বিনির্মাণের জন্য যুদ্ধ।
মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ বপিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। নিজেদের ভাষা, ঐতিহ্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসহ আমাদের বাঙালি স্বাতন্ত্র্য বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভাষা সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল। পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠীর হাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালিদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র সত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। তাই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার স্বাধীনতার জন্য, মাতৃভাষার মুক্তির জন্য ভাষা আন্দোলনে আত্মাহুতি দিয়েছিল রফিক, শফিক, বরকতসহ নাম না জানা আরোও অনেকে।
স্বাধীনতার মূলমন্ত্রের সাথে ভাষা ও সংস্কৃতির মুক্তির বিষয়টিও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশ ইহিতাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ অনন্য এক দেশ। যুগযুগ ধরে ইতিহাসের পরতে পরতে রয়েছে আমাদের সংস্কৃতির উজ্জ্বল বিচরণ। অথচ, আমরা বিদেশি অথবা পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনকে বিশেষ করে দেখছি, কিন্তু আমার কাছে সাংস্কৃতিক এই অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে বিদেশি বা পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন মূখ্য নয়, বরং বহুবছর ধরে নিজস্ব তথা বাঙালি সংস্কৃতির বিকৃতি ও অপচর্চাই প্রধান। অথচ একদিন এই ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য, মায়ের ভাষার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিল আপামর বাঙালি। ভাষার স্বাধীনতার জন্য রাজপথ করেছিল রঞ্জিত। তাই আমার কাছে স্বাধীনতা মানে মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলা। বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে অনন্য উচ্চতায় স্থান দেয়া। তাই তো ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের ফসলস্বরূপ বাংলা ভাষা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলমন্ত্রের অন্যতম বিষয় ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ যখন একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশের কাতারে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছে, ঠিক তখন এমন অস্থির, ভয়ংকর বৈশ্বিক পরিবর্তন আগে আসেনি প্রকৃতিতে। মানব জীবনে এমন ভয়ানক বিপর্যয় আসেনি কয়েক দশকেও। মহামারি থেকে শুরু করে সামাজিক অবক্ষয়ের এমন বিবর্ন, এমন ধূসর-ভয়ংকর চিত্র বাংলাদেশ আগে দেখেনি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে এমন প্রাকৃতিক এবং মানবিক বিপর্যয় ভাবিয়ে তোলে। সংশয়-ভয় মিলেমিশে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে সবার মনে। প্রশ্ন একটাই-এই সামাজিক দূরত্বের আতঙ্ক থেকে পরিত্রাণ হবে কবে? মুক্ত বাতাসে দু হাত প্রসারিত করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেব কবে? স্বাধীনতা মানে আমার কাছে মুক্ত বাতাসে নির্ভয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া। স্বাধীনতা মানে বাংলাদেশের প্রতিটি নারীর নির্ভয়ে পথচলা, স্বাধীনতা মানে নারী বান্ধব মানবিক-নির্মল একটা বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আরোও যে বিষয়টি উল্লেখ্য তা হল, বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিষ্পেষণমুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। তাই আমার কাছে স্বাধীনতা মানে নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মানুষের সমান অধিকার প্রয়োগ।
পঞ্চাশ বছর আগের অর্জিত স্বাধীনতা ও আজকের বাংলাদেশের অবস্থান অনেকাংশেই ভিন্ন।বিশ্ব পরিমন্ডলে বাংলাদেশ এখন দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অনুকরণীয় একটি দেশ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের অনেক না পাওয়া আছে, অনিয়ম আছে, সংকট আছে, আবার বাংলাদেশের সম্ভাবনাও আছে, আছে নিজের পায়ে ঘুরে দাঁড়ানোর বৈচিত্র্য। বিশ্বাস করি, যেকোনো খারাপ পরিস্থিতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে সহসা। সাফল্য আর সমৃদ্ধির উন্নত শিখরে নাম থাকবে বাংলাদেশের।
আমরা পরিশ্রমী জাতি। আমরা যুদ্ধজয়ী জাতি। যেকোনো অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত এ প্রজন্ম। অনেক সংকটের মধ্যেও আমাদের আকাশচুম্বী সাফল্য আছে। স্বপ্ন আর আবেগের সফল সমন্বয় ঘটাতে পারি আমরাই। এটাই আমার কাছে স্বাধীনতা।
পরিশেষে, উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, সংশয়, ভয় ও মহামারিমুক্ত সুবর্ণ জয়ন্তী আসুক অসাম্প্রদায়িক স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে। স্বাধীনতা মানে আমার কাছে, বাংলাদেশ হবে একটা সম্ভাবনাময় ক্যানভাস, সেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাফল্যের ছবি আঁকবে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী, সমৃদ্ধশালী, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক এক বাংলাদেশের।
লেখক:
কবরী বিশ্বাস অপু
ভাস্কর ও পিএইচডি স্কলার,
মহারাজা সায়াজিরাও ইউনির্ভার্সিটি অব বরোদা