ইমরান হুসাইন
সময়ের বিবর্তনে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ হয়েছে, নীলকররা চাটিবাটি গুটিয়ে চলে গেছে,তবুও কৃষকের দুর্দশার সামান্যতম লাঘব হয়নি। এখনও এদেশে অধিকাংশ জমির মালিক নব্য জমিদার, ছদ্ম জমিদার ও গ্রামীণ মহাজন। এছাড়াও স্থানীয় বাজারের ক্রেতারাও বাজারের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। নিত্যনব আঙ্গিকে তারা কৃষকের দিকে বাড়িয়ে দেয় শােষণের হাত। যে কৃষককে জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হয়, সে কৃষকই এখন মেরুদন্ডহীন। অব্যাহত শােষণে সে হারিয়ে ফেলেছে তার মনুষ্যত্ববােধ। বর্তমানকে সমৃদ্ধ এবং ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করার কোনাে স্টাইল তার নেই। বস্তুত তার কোনাে স্বপ্নই যেন নেই। স্বপ্নহারা এই কৃষক এই একবিংশ শতাব্দীতেও চাষ করে আদ্যিকালের লাঙ্গল আর গৃহপালিত পশুর সাহায্যে।যদিও জায়গা বিশেষ প্রযুক্তির কিছুটা উন্নতি হয়েছে তবুও রয়ে গেছে দুর্দশা। এখনও সে প্রকৃতির খেয়াল-খুশিনির্ভর গুটির মতো ব্যবহার হয়। বৃষ্টি-বন্যা ও খরার ওপর নির্ভর করে তার ভাগ্য। এত প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার সাথে থাকে আবার নানা রকম মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যাবলী যার বলি হতে হয়, এই বাংলার সহজ-সরল মাটির মানুষ, এই বাংলার নিপীড়িত কৃষকদেরই।যুগযুগ ধরে তারা শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের মধ্য দিয়েই নিজের কাধে লাঙ্গল জোয়াল বয়ে গতিশীল রেখেছে আমাদের অর্থনীতিকে, আমাদের দেশকে।
আমরা জানি যে, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষি এবং কৃষকের উপর দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্র ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু সেই কৃষকই আজ সব থেকে কোনঠাসা অবস্থায় পরিনত হয়েছে। করোনার এই মহামারির কালে দ্রব্যমূল্যের, কীটনাশকের, সার, বীজ সহ সকল প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বেড়ে যাওয়াতে ও বন্যা জলোচ্ছ্বাস এর কারণে ফসলের বিরুপ ক্ষতি হয়েছে। যা একজন কৃষকের জন্য বেশ করুণ অবস্থার সৃষ্টির কারণ। তারপরও এই করোনা ও বন্যা জলোচ্ছ্বাস কাটিয়ে উঠে সারাদেশেই কৃষকেরা অন্যান্য ফসলের ন্যায় কৃষকেরা আমন ধান উৎপাদনে বেশ ভালো ফলন পেয়েছে কিন্তু এত ভালো ফসল উৎপাদনে তাদের লাভ কই? যত ভালো ফসলই উৎপাদন হোক আর যত ভালো ফলনই হোক না কেনো সেই ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেলে এত ভালো ফসল বা ভালো ফলন মূল্যহীন। বর্তমান পরিস্থিতিও তাই করোনা, বন্যা উপেক্ষা করে কৃষকের এই ভালো ফলন আজ মূল্যহীন হয়ে পড়েছে কেননা তাদের ফসলের নেই ন্যায্যমূল্য। নেই ধানের বাজারে সঠিক ব্যবস্থাপনা।
স্থানীয় ব্যাপারী, মহাজন বা চাউলের মিল মালিকরাই নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার। আমন ধান উঠার আগেও ধানের মন ছিলো ১০০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু ধান বাজারে আসার পরই ধানের বাজারে ধস নেমে মনে ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত কমে এসেছে। বাজারে বেড়েছে বিক্রেতার সংখ্যা। ধানের বাজারে যোগানের পরিমান অধিক হারে বেড়ে গেছে সেই সাথে কমেছে ক্রেতাদের চাহিদার পরিমান। ফলে বাধ্য হয়ে প্রয়োজনের তাগিদে কম দামেই ধান বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। সারাদেশে কৃষকদের এই একই অবস্থা। কম দামে কৃষকের এই ধান বিক্রি না করেও কোন উপায় নেই কেননা আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকেরা একেবারেই অস্বছল। তারা যেকোন ফসল উৎপাদনের সময় প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সব বাকিতে গ্রহণ করেন এবং তাদের লক্ষ্য থাকে ফসল বিক্রি করে সকল দেনা-পাওনা বা বকেয়া পরিশোধ করবে৷অন্যদিকে পাওনাদাররাও ফসল উত্তোলনের পরপরই হালখাতা বা তাদের টাকার তাগিদ দিতে থাকে যার ফলে কৃষকেরা কম দামে হলেও ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। কৃষকের এমন কঠিন সময়ে তাদের ন্যায্য মূল্য পাবার লক্ষ্যে সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।তাদের প্রতি যাতে কোন অবিচার না হয় সে দিকে নজর রাখতে হবে।
দেশের মঙ্গল আর কৃষকের মঙ্গল তাই একসূত্রে গাঁথা। বঙ্কিমচন্দ্র হয়তাে এজন্যই বলেছেন, দেশের মঙ্গল, কাহার মঙ্গল? তােমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ?তুমি আমি দেশের কয়জন? আর এই কৃষিজীবী কয়জন? তাহাদের ত্যাগ করিলে দেশের কয়জন থাকে? হিসাব করিলে তাহারাই দেশ- দেশের অধিকাংশ লােকই কৃষিজীবী। এই কৃষকদের উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি। তাদের শ্রম আর ঘামের সঙ্গে দেশের অস্তিত্ব একাকার। তারাই দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ডের শক্ত দাড়।
যে কৃষক বিরামহীন শ্রম আর সাধনার মাধ্যমে ফসল ফলায়,দেশের আর্থিক বুনিয়াদ শক্তপােক্ত করে তােলে সেই কৃষকে অস্তিত্ব এদেশে বড়ােই নড়বড়ে। অনশন-অর্ধাশন, রােগ-শোক, দুঃখ-বেদনা, অবহেলা-অপমান, শােষণ-বঞ্চনাই তাদের একমাত্র বিধিলিপি। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাদেশে কৃষকদের অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত সচ্ছল। মানুষ যখন ছিল গ্রামসীমার মধ্যে আবদ্ধ এবং বহির্বিশ্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত, তখন কৃষিজাত সীমিত দ্রব্যসামগ্রী নিয়েও তাদের সুখ ছিল অন্তহীন। কৃষিজমির সঙ্গে তাদের অস্তিত্বের যােগ।
যে কৃষকের ওপর ভর দিয়ে চলছে নিখিল সংসার সেই কৃষক যাতে সর্ববিধ বঞ্চনা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনসস্তায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে আমাদের উচিত সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা। হাজার বছরের নিগ্রহদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের কৃষক সমৃদ্ধির ধারাস্নানে প্রাণময় হয়ে উঠবে, মনুষ্যত্বের বােধে মণ্ডিত হবে এই প্রত্যাশা আমাদের। কৃষকেরা তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য পাক। তাদের হাত ধরেই এগিয়ে যাক দেশ ও দেশের অর্থনীতি।
লেখকঃইমরান হুসাইন
শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়