মোঃ আশিকুর রহমান (সৈকত)
২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর প্রকাশিত হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ফলাফল। ২১তম হয়ে পেয়ে যাই বিদ্রোহী কবির নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ। ভাইভার পর ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের সুযোগ পেলেও ভর্তি হওয়া হয়নি। ভর্তি হয়েছিলাম সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগে। এই অনুষদে অবশ্য ১৬ তম হয়েছিলাম। সে যাইহোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই ঊনবিংশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি সম্পর্কে, তার সৃষ্টি, তার দর্শন, তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানার আগ্রহ খুব বেশী বেড়ে গিয়েছিলো।
কেননা পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েই কবির ছোঁয়ায়, স্মৃতিতে জীবন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য ধূমকেতু, প্রভাতি, প্রলয় শিখা, বাঁধনহারা নামের বাস কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেই খানিক এগোলেই ‘চির উন্নত মম শির’ নামক স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা ‘গাহি সাম্যের ম ’, ‘চুরুলিয়া ম ’ এর দেখা মিলবে৷ কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘দোলনচাঁপা’র নামে শিক্ষার্থীদের হল, কাব্যগ্রন্থ ‘চক্রবাক’ এর নামে ক্যাফেটেরিয়া, ছোটগল্প ‘ব্যথার দান’র নামে মেডিকেল সেন্টার কিংবা কবির ডাকনাম দুখু মিয়ার নামে নামকরণকৃত উপাচার্যের বাসভবনের নামকরণে এই বিদ্রোহী নটরাজের আবেদন বাড়িয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। এ কারণেই তিনি ভূষিত হন বিদ্রোহী কবি হিসেবে। আজীবন সংগ্রাম করেছেন শোষিত মানুষের মুক্তির জন্যে। সোচ্চার ছিলেন সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডকতার বিরুদ্ধে। তরুণদের কাছে তিনি বিদ্রোহের অনন্ত প্রতীক। আমিও এর ব্যতিক্রম নই, চির উন্নত মম শির কাজী নজরুল ইসলামকে মননে লালন, ধারণের সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাই।
কবি তার মাত্র দুই যুগের সৃষ্টিকর্ম জুড়ে পরাধীন দেশের মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। তিনি পুতুলের বিয়ে (১৯৩৩) নাটিকায় লিখেছিলেন, মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ। নজরুল হিন্দুমুসলিম ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানবধর্মকে লালন করার কথা বলেছেন। তিনি ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে মানবতাকে সবচেয়ে বড় করে দেখার জন্য সাম্যবাদী (১৯২৫) কবিতায় বলেছেন, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, সবদেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জাতি। নজরুল তাঁর সাহিত্যে পারষ্পারিক সাংস্কৃতিক সমন্বয়কে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, এর ফলে দুই প্রধান স¤প্রদায়কে এক কাতারে আনা এবং সমাজে অধিকতর সহনশীলতা নিশ্চিত করা যাবে। তাই তিনি হিন্দু ও মুসলমান ধর্মীয় বিভিন্ন চরিত্রকে সংমিশ্রণ করে ব্যবহার করেছেন।
নজরুল তাঁর সাহিত্যকর্মে নারী-পুরুষকে সমানভাবে দেখেছেন। তিনি নারীকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হননি। তাঁর মতে, পৃথিবীতে সকল ‘কল্যানকর অবদানের অধিকারী হচ্ছে এই নারী। তিনি নারী (১৯২৫) নামের কবিতায় বলেন, ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমনীর কোনো ভেদাভেদ নাই। বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। এর মাধ্যমে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের ইঙ্গিত দিয়েছেন। নজরুল অন্যান্য লেখনীতেও নারীর প্রতি গভীর সম্মান প্রদর্শন করেছেন।
নজরুল সবসময় চেয়েছেন, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী ধর্মীয় সাংস্কৃতির রাজনৈতিক ভৌগোলিক অচলায়তন ভেঙে ফেলতে। অন্তরের গভীর উপলব্ধি থেকে উচ্চারণ করেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান। তিনি মানুষের ভেতরে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যয়ের অনমনীয় চিত্তকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
মহান কবির নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমি চাই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর চেতনায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উৎপাটন করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। জেগে উঠুক মানুষের ভেতরে আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যয়ের অনমনীয় চিত্ত। তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, দেখিয়েছিলেন। তার জীবনাদর্শ অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ, সুখী-সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ হোক-এটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখক:
মোঃ আশিকুর রহমান (সৈকত)
শিক্ষার্থী
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়