ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

করোনাকালে দুর্গাপূজা ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ভাবনা

“আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির,
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা,
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা”

মহালয়ার এই পূণ্যলগ্নে জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমনী শারদ বার্তা ঠিকই উৎসবের সূচনা করে দিয়ে গেল ধরণীতে। তবে, ধরণীর বুকে এমন ঘন-কালো মেঘমালাময় বৈরী রূপ আগে দেখেনি কেউ। এমন বাংলাদেশও দেখেনি এ প্রজন্ম। করোনা মহামারির কবলে পুরো পৃথিবী যখন বিপর্যস্ত তখন কাশফুল শোভিত শুভ্র ক্যানভাসে সুনীল শরৎ এসেছে তার ধারাবাহিকতা নিয়ে। শিউলি শোভিত সকাল আর পদ্মফুলের বুকের ভেতরে ভ্রমরের গুনগুন শুনিয়ে গেল দশভুজার আগমনেরই ধ্বনি। কিন্তু নিয়ম অনুসারে এই শরতে দেবী দুর্গার মর্তে আসা হলনা।মহালয়ার পরে দশভুজার আসতে দেরি হল আরও একমাস। ততদিনে প্রকৃতির তার অকৃপণ হাতে সাঁজিয়ে দিয়েছে হিমহিম হেমন্তকে।

এমন অস্থির, ভয়ংকর ঋতুবদল আগে আসেনি প্রকৃতিতে। মানব জীবনে এমন ভয়ানক বিপর্যয় আসেনি কয়েক দশকেও। মহামারি থেকে শুরু করে সামাজিক অবক্ষয়ের এমন বিবর্ন, এমন ভয়ংকর চিত্র বাংলাদেশ আগে দেখেনি। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে এমন প্রাকৃতিক এবং মানবিক বিপর্যয় ভাবিয়ে তোলে। সংশয়-ভয় মিলেমিশে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে সবার মনে। প্রশ্ন একটাই-এই সামাজিক দূরত্বের আতঙ্ক থেকে পরিত্রাণ হবে কবে? মুক্ত বাতাসে দু হাত প্রসারিত করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেব কবে?

এবছর নিয়ম রক্ষার দেবী দুর্গা বরণ হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু উৎসবের আমেজ বিরাজ করছেনা বাঙালির মনে।বিশেষ করে দেবীরূপী-মাতৃরূপী নারীর মনে! কোথাও নেই কেনাকাটার উচ্ছ্বাস, নেই মুখরতা। ছেলেবেলার বন্ধু মহলে নেই কোনো বিশেষ পরিকল্পনা। শিশুদের মনেও কাজ করছে আতঙ্ক। ঘরে ঘরে নাড়ু-লুচি তৈরির নেই তেমন কোনো আয়োজন। জীবন বন্দী যেন ভার্চুয়াল ফ্রেমে। অথচ, আমার কাছে বাংলাদেশের উৎসব মানে আনন্দ, উৎসব মানে সম্প্রীতি, উৎসব মানে সমৃদ্ধি। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একটা প্লাটফর্মে নিয়ে আসা। তেমনই বাংলাদেশের দুর্গোৎসব অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নিদর্শন।

যদিও অতীতে অনেক সংগ্রাম-সংকট পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। বদলে গেছে সময়, বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। ঋতুতেও এসেছে পরিবর্তন। কিন্তু অতীতে বাংলাদেশের উৎসব-আনন্দ কখনও মলিন হয়নি। তবে এবারের দুর্গোৎসব আয়োজনে এসেছে নানান পরিবর্তন। অতীতের প্রথাসিদ্ধ সমস্ত রীতিনীতিকে সরিয়ে রেখে প্রতিমা প্রতিস্থাপনে এসেছে আমূল পরিবর্তন। একই দেবী অথচ মন্দিরে মন্দিরে দেবী দুর্গার ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপন। দেবীর পোশাক, সাজসজ্জা থেকে শুরু করে নির্মাণশৈলীতে এসেছে বৈচিত্র্য। কোথাও কোথাও মহামারিকে উপজীব্য করে প্রতিস্থাপিত হয়েছে প্রতিমা।

তবে, মহামারির ভয়াবহতা মাথায় রেখে দেবী বন্দনায় কোথাও নেই জমকালো কোনো আয়োজন, নেই কোনো আলোকচ্ছটা, কারো মনে নেই রঙের ছোঁয়া। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধিকে গুরুত্ব দিয়ে মন্দিরে মন্দিরে থাকছেনা প্রসাদ বিতরণের সেই চিরাচরিত আয়োজন।

শিল্পীর ক্যানভাস থেকে শুরু করে ভাস্করের ভাবনা, সবখানেই মহামারীর ভয়ংকর প্রভাব বিদ্যমান। গত কয়েকবছরের তুলনায় এবারের পূজার আয়োজন একেবারেই ভিন্ন। করোনা মহামারির পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া বাংলাদেশে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা এবং নারী নির্যাতনের ভয়াবহতার মধ্যে দুর্গতিনাশিনীর চির প্রত্যাশিত আগমন আতঙ্কিত করে তুলেছে সমগ্র বাংলাদেশকে। যেখানে মাতৃরূপী দেবীর বন্দনাতে ব্যস্ত, ব্যাকুল ধরণী, সেখানে নারীর প্রতি এই অমানবিক আচরণ ভাবিয়ে তোলে! এমন ধুসর-বিবর্ন উৎসব আয়োজন মনকে আচ্ছন্ন করে তোলে, আরও মলিন করে তুলছে সবাইকে। পূজা পূজা আমেজ বিরাজ করছেনা কোথাও। শংকিত-স্তম্ভিত হয়ে আছে চারপাশ।

এমন সংকটকালে মহা ষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমী হৈমন্তী দেবী অভয়ার আরতিতে দূর হোক সকল নৃশংসতা। দুর্গতিনাশিনীর অঞ্জলির মাধ্যমে দূরীভূত হোক মহামারি। দেবী বিসর্জনের সাথে পুরুষরূপী অসুরদেরও বিনাশ হোক পৃথিবী থেকে। সেই সাথে বাংলাদেশের প্রতিটি নারী বাঁচুক নির্ভয়ে। মাতৃরূপে দেবী মর্যাদায় মাথা উঁচু করে পৌঁছে যাক বিশ্বদরবারে। দেবী দুর্গার আশীর্বাদে নারী বান্ধব মানবিক-নির্মল একটা বাংলাদেশ হোক প্রত্যাশা। উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, সংশয়, ভয় ও মহামারি মুক্ত সুবর্ণ জয়ন্তী আসুক অসাম্প্রদায়িক, মানবিক স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে। শারদীয় শুভেচ্ছা সবাইকে।

_________________

লেখক: কবরী বিশ্বাস অপু
ভাস্কর ও পিএইচডি স্কলার (আইসিসিআর)

আনন্দবাজার/শাহী/শাহিন

সংবাদটি শেয়ার করুন