ইফতেখায়রুল ইসলাম
সমাজে যৌনকর্মী হিসেবে পরিচিত যে নারী, তিনিও যদি শারীরিক নির্যাতনের অথবা যৌন হয়রানির শিকার হোন তারও অধিকার আছে আইনী সেবা পাবার! শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে অনীহা প্রকাশ করার সাথে সাথেই তার উপর শারীরিক বল প্রয়োগ আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হয়ে যাবে! আইনের সৌন্দর্য এখানেই! হ্যা প্রমাণ করতে সময় লাগলেও দিনশেষে সিস্টেমের বাইরে কিছুই হয় না!
১৬ বছরের একটি মেয়ে কোনো ২১ বছরের ছেলের সাথে চলে গেলে আমরা শুনি অমুক মেয়ে তো নিজেই পালিয়ে গেছে, তাহলে তার অভিভাবক আবার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করে কেন? আপনার, আমার দৃষ্টিতে ১৬ বছরের মেয়ে অনেক ম্যাচিউরড হলেও আইন তাকে শিশু হিসেবে বিবেচনা করেছে, তাই সে এক্ষেত্রে কোনো অভিপ্রায় প্রকাশ করলেও প্রাপ্তবয়স্ক কেউ তাকে নিয়ে কোথাও চলে গেলে অথবা তার ইচ্ছানুসারে শারীরিক সম্পর্কে জড়ালেও সেটি আইনত দন্ডনীয় অপরাধ! কাজেই আইনী ব্যবস্থা নেয়ার সম্পূর্ণ অধিকার তাদের আছে!
অন্যদিকে আমাদের দেশে একটি খুব মজার বিষয় আছে, কারো নামে মামলা হলেই আমরা ধরে নেই সে অপরাধী! অথচ সকল সাক্ষ্য, প্রমাণ শেষে অভিযুক্ত ব্যক্তি নিরপরাধী প্রমাণিত হতেই পারেন, নির্দোষ বলা হলে কখনোই তাকে আর অপরাধী বলা যাবে না! মামলায় অভিযুক্ত হয়ে নিরপরাধ প্রমাণিত হওয়ার এরকম উদাহরণ হাজারে হাজারে আছে। ভুক্তভোগী মাত্রই এই বলার সাথে নিজেকে কানেক্ট করতে পারবেন। মামলা হওয়ার পর, আমরা যেটি করি, “আরে জানো না তার নামে তো মামলা হইছে, ঘটনা না ঘটাইলে কি আর হয়েছে”!? সিটিজেন জার্নালিস্টগণ এসব বিষয়কে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন যে এখন মূল ধারারও কেউ কেউ ত্বরায় পড়ে যান! এটা খুবই ভয়াবহ একটি বিষয়! আমি সবসময় মূলধারা ও সিস্টেমের উপর বিশ্বাস রাখতে চাই; কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও এর বিকল্প কিছু নেইও! কারণ দিন শেষে নির্ভরতা বলেন আর পার্থিব জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল যাই বলেন না কেন, তার সমাধান সিস্টেমেই নিহিত!
আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমরা যারা একদিকে বিচার চাই, বিচার চাই বলে চিৎকার করি, তারা নিজেরাই বিচারের পথে অজান্তেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করি! কে জানে কেউ কেউ হয়তোবা জেনে, বুঝেই করি! মজাটি যেখানে সেটি হলো, একজনের ক্ষেত্রে যেই ভুলটি আমরা ধরিয়ে দিচ্ছি, আরেকজনের ক্ষেত্রে নিজেই সেই ভুলটি করছি! একটি বিষয় তো সত্যি চেক, ক্রসচেক ছাড়া চাপে ফেলে দেয়ার নতুন যে প্রবণতা সেখানেও ভ্রান্তি থাকতে পারে! পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত সেই ভ্রান্তির দায় আমরা কেউই কি কাঁধে তুলে নেই?
প্রায় দুই বছর আগে একটা ইস্যু নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটলো, যে ব্যক্তি এই কান্ডের নায়ক, পরবর্তী সময়ে সেই ব্যক্তির সাথে যাদের যাদের স্থিরচিত্র পাওয়া গেছে তাঁদের সকলের একযোগে মানহানি করেছেন সচেতন সমাজের একটি অংশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার প্রায় অনেকেই! বর্তমান সময়ে কোনো ব্যক্তির সাথে একটি স্থিরচিত্র থাকা কতটা স্বাভাবিক, সেটি বেমালুম নিজেরা ভুলে অন্যদেরও ভুলতে সাহায্য করেছেন অতি জ্ঞানী, গুণীজন! কথা হলো বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত অপরাধীর কপালে তো আর লিখা থাকেনা যে, সে অপরাধী! এমনকি অন্য এলাকার অপরাধী আরেক এলাকায় সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে সমাদৃত হওয়াটাও খুব অস্বাভাবিক নয়! এতে অজানা অপরাধী বা নিরপরাধী ব্যক্তির সাথে, স্থিরচিত্রে থাকা ব্যক্তির দায় কতটুকু? আবার আজকের নিরপরাধী ভবিষ্যতের অপরাধী হয়ে উঠবেনা তার গ্যারান্টিও কি দেয়া সম্ভব? স্থিরচিত্রে না থাকাটাই তবে সবচেয়ে উত্তম পন্থা হবে বোধ করি, সেটি করলে আপনারাই আবার বলবেন, কি অহংকারীরে বাবা? মানুষ আসলে যাবে কোথায়?
একটি ঘটনার অপরাধে অপরাধীকেই শাস্তি দেয়া হয়, তার ভাই, বোন কিংবা মা, বাবাকে নয়, যদি না তাঁরা সংশ্লিষ্ট থাকেন! অপরাধীর আত্মীয় কাছের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আইন অনুসারে তার দায় থেকে মুক্তি মিললেও, কোনো অপরাধীর সাথে কারো স্থিরচিত্র থাকলে আমরা মোটামুটি দাগী আসামী বানিয়ে ফেলি! এটুকু বিবেচনায় রাখলে, স্থিরচিত্র দিয়ে কাউকে সমালোচনা করার অধিকার কি আমরা রাখি? ঘটনার প্রেক্ষিতে অপরাধের সাথে কোনো স্থিরচিত্রের সম্পর্ক থাকলে সেটি নিয়ে আইন, আদালতে প্রমাণের বিষয় আছে! প্রমাণ ছাড়া আমরা যেটি করছি সেটি এক ধরণের মহা অন্যায় বা অপরাধ! আগামীতে এর ফলাফল খুব সুখকর কিছু হবে না! এর প্রভাব ইতোমধ্যে দেখছিও আমরা!
ডেমরা জোনের এসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে, এক নারী নিজে ধর্ষিতা হয়েছেন মর্মে, ৩ মাস পর অভিযোগ নিয়ে আসেন! ওসি শুনলেন তার মনে সন্দেহ হলো, তিনি আমার কাছে পাঠালে আমারও কিঞ্চিত সন্দেহ হলো! তিনি জোরালোভাবে বলছিলেন আমরা যদি মামলা না নেই তিনি তাৎক্ষণিক সাংবাদিক ডেকে প্রেস কনফারেন্স করবেন! একই রকম একটি ঘটনা নিয়ে তখন চারপাশ তোলপাড়, তাও ওসি সাহেব খোঁজ খবর নিয়ে মহিলার মামলা গ্রহণ করলেন অবশেষে। এখন কেউ তো আর দৈবশক্তি নিয়ে বসে নাই, কার মনে কি চলে সেটি তো আর বুঝে ফেলার কায়দা নেই! তাই নিয়ম অনুসারে মামলা নেয়াটাই যথাযথ প্রক্রিয়া! মামলা নেবার পর তদন্ত প্রক্রিয়ার কয়েকদিন যেতে না যেতেই তথ্য প্রযুক্তি ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক সাক্ষের ভিত্তিতে আমরা বুঝে গেলাম এটি একটি মিথ্যা মামলা! কিন্তু আমাদের সমাজ? মামলা হয়েছে মানে ওই লোককে অপরাধী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন অনেকেই! সেই চাপের সময় অফিসার ইনচার্জ যদি মামলা না নিতেন তখন পত্রিকায় শিরোনামটি যেমন হতে পারতো “ধর্ষিতার মামলা নিলেন না অমুক থানার পুলিশ”! মামলা নেয়ার পর যেটি সত্যি সত্যি লিখা হলো, “ধর্ষণের মিথ্যা মামলা নিলো অমুক থানা পুলিশ”! যাওয়ার রাস্তাটি আসলে কোথায়? নিজেকে এমন সিচুয়েশনে দাঁড় করিয়ে উত্তর খুঁজবেন আশা করি! পরবর্তী সময়ে পুলিশ সেই মামলায় ‘চূড়ান্ত রিপোর্ট মিথ্যা’ প্রতিবেদন দিয়ে বাদিনীর বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ২১১ অনুসারে ব্যবস্থা নেবার অনুরোধ জানিয়ে বিজ্ঞ আদালতের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। এখানে দায় আসলে কার? এসব ভাবনা কি আমাদের মননে, মগজে নাড়া দেয় কখনো? এই অস্থির সময়কে নিয়ে আমি ভীষণ ভীত!
সাদা চোখে দোষারোপ করে ফেলা অনেক সহজ, অনেক সহজের উত্তর আপনাদের সাদা চোখ দেখেনা, জানতেও পারেনা। আর আমাদের জানানোর সময়ও নেই। দোষীকে নিয়ে প্রতিবাদ করুন, তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করুন সেটা সাধারণের মত আমাদেরও চাওয়া! কিন্তু আইন যেমনটি বলে, একজন নিরপরাধীও যেন শাস্তি না পান! ব্যক্তি আমি থেকে ধরে আপনারা, আমরা কেউ কি আইনের এই সৌন্দর্যের সাথে একমত হতে পেরেছি? আদৌ কি পারবো? ভুল শুধু একদিকেই হয়না, হয়নি, হবেনা! ভুল চারিদিকে হয় এবং হচ্ছে … কিন্তু সেটি স্বীকার করে নেবার জন্য যে মানসিক শক্তি বা দৃঢ়তার প্রয়োজন, তা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে আছি!
লেখক : অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, পল্লবী জোন গোয়েন্দা বিভাগ (ডিএমপি)।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)