মো. রমজান আলী মিয়া
আমার স্ত্রী বললো নামাজ এতো তাড়াতাড়ি শেষ হলো? এমন প্রশ্নের উত্তর না হয় একটু দেরীতে দেই। আমি পোশাক পরিহিত কর্তব্যরত আছি এমন সময় মুখে হালকা দাঁড়ি, আবার কারো মুখে দাঁড়ি নেই এবং মাথায় শুধু টুপি। দেখেই বুঝতে পারছি দল বেধে যেহেতু আমার দিকে আসছে, নিশ্চয় তবলীগ জামাতের লোক হবে। আমার অনুমান যা তা-ই হলো।
উনারা আমাকে দুনিয়া, আখেরাত, নামাজ নিয়ে নানারকম কথাই বললেন। আমি শুনলাম উনাদের কথা। কথাগুলো মন্দ নয়, কিন্তু পালন করাটাই আসল কথা। যাক, বিভিন্ন কথার মধ্যে হঠাৎ আমি বললাম আচ্ছা বলুন, দৈনিক সতেরো রাখাত নামাজ ফরজ হয়েছে কিন্ত একমাত্র জুম্মার দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পনেরো রাখাত ফরজ কেন? না-কি জুম্মার দিন বলে দু’রাখাত মাফ? প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দাড়িতে হাত দিলেন! কেউ একজন বললেন যে, আগে থেকে আসছে তাই। এ প্রশ্নের দ্বারা কি সমগ্র তাবলীগ লোকের মান নির্ণয় করা যাবে তা কিন্তু নয়। এখানে বিখ্যাত আলেম-উলামা ও বুজুর্গগণ সহ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও আছেন। যাদের জ্ঞানের মাত্রা অনেক উঁচুতে ।
রাসুল (সা:) মক্কা নগরী থেকে মদিনায় হিজরত করছিলেন। তিনি ‘বনিছালেম’ নামক এক গোত্রের উপত্যকায় পৌছা মাত্র জহুরের আযান হয়। দিনটি ছিল ‘ইয়াওমুল আরুবা’ অর্থ্যাৎ শুক্রবার দিন।
আযান হওয়ার পর তিনি দু’রাকাত জুম্মার নামাজ আদায় করেন। আর সে থেকেই জুম্মার নামাজ দু’রাকাত ফরজ পড়ার বিধান চলে আসে। ঈমাম সাহেবের খুৎবাকে বাকী দু’রাকাত ফরজ নামাজের সমতুল্য হিসাবে ধরা হয়। মোট চার রাকাত তাহলে শুক্রবার দিনও সতেরো রাকাত ফরজ নামাজ হয়। এখন জুম্মা শব্দের অর্থ সমাবেশ, কাতার বদ্ধ হওয়া ।
এই দিনে আদম (আ:)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে ইসরাফিল (আ:)-এর সিঙ্গায় ফুৎকারে সব মানুষ মাটির গর্ত থেকে উঠে হাশরের ময়দানে সমবেত হবে। জুম্মার দিনকে সাপ্তাহিক ঈদের দিন বা গরীবরে হজের দিন বলা হয়।
আমাদের গ্রামেগঞ্জে ও হাট-বাজারে মসজিদের অভাব নেই। রাসুল (সা:) ও আল্লার ঘর (মসজিদ) তৈরীতে বেশ তৎপর ছিলেন। রাসুল (সা:) মসজিদ তৈরী করতেন তাকওয়া অর্জনের লক্ষে। আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে গোত্রের কথা চিন্তা করে।
কিন্তু বর্তমানে আমরা যদি তাকাই, বড় কোন গ্রামের দিকে উত্তর পাড়া, দক্ষিণ পাড়া, বেপাড়ী পাড়া, এরকম পাড়ায়-পাড়ায় মসজিদ গঠন হচ্ছে। কেন এতো মসজিদ? গ্রামে বিভিন্ন দলাদলি পাড়ায়-পাড়ায় টাকার গরম, অহংকার, রেষারেষি থেকেই ধর্মীয় বিষয়গুলো বিভিন্ন স্থরে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
যেখানে শুক্রবার সাপ্তাহিক ঈদের দিন, যেখানে জুম্মার দিনও অন্তত দশ থেকে বারো গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে যদি নামাজ না পড়তে পারি তাহলে কি ঈদের দিন মনে হবে? মনে কোনো আনন্দের সঞ্চার হবে?
দশ, বারো গ্রামের জন্য একটি মসজিদ হবে আর সেটা বিশাল জায়গা বিস্তৃত থাকবে, বিশাল অজুখানার ব্যবস্থা থাকবে, প্রতি ওয়াক্তে কম করে হলেও এক থেকে দু-হাজার লোকের সমাবেশ ঘটবে। তাহলেই না মনে হবে আজকে শুক্রবার (ঈদের দিন), গরীবের হজের দিন।
আজকাল প্রায় জায়গায় মসজিদ কমিটি নিয়ে নানা ধরনের উচ্চবাচ্য হয় । কাদের নিয়ে কমিটি করা হবে এখানে কোন অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে কি-না এব্যপারে সন্দিহান! যারা নিয়মিত মসজিদে যাতায়াত করবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যারা মসজিদে আযান হওয়ার সাথে সাথে আদায় করবে তারাই তো কমিটিতে স্থান পাওয়ার জন্য বেশী হক্বদার।
অথচ দেখা যায়, নামাজের খবর নাই! সপ্তাহে একদিন শুক্রবার পায়জামা ও পাঞ্জাবির সাথে কটি লাগিয়ে, আতর লাগিয়ে ঠিক ঈমাম সাহেবের পেছনে গিয়ে বসে। উনি কি ফজরের নামাজ আদায় করছেন কি-না এব্যপারে সন্দিহান!
জুম্মার দিনে মসজিদ কানায় কানায় পূর্ণ। জুম্মার নামাজে যদি মসজিদ ভরে যায় তাহলে ঐদিনই আরো চার ওয়াক্ত নামাজ আছে সেসময় কেন মসজিদ ভরে উঠে না? তাহলে কি একদল লোক ধরে নিয়েছে শুধু শুক্রবার দিন জুম্মার নামাজ পড়লেই হবে বাকী ওয়াক্তের দরকার নেই। ইসলাম কি এমন বিষয়গুলে সমর্থন করে? এমন-কি যতটুকু সময় নামাজ কায়েম করলাম অন্তত ঐ সময়টুকুর জন্য আমি সওয়াব পেলাম কিন্ত বাকী সময়ের কি জন্য প্রয়োজন নেই?
মানুষের সাথে চালাকী করে হয়তো পাড় পেতে পারি কিন্তু আল্লাহর সাথে চালাকী করে পাড় পাওয়া যাবে? এ ভাবনা আামাদের মাথায় থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। পবিত্র কোরআনের সুরা ইন ফিতারে উল্লেখ আছে ‘কিরামান কাতিবিন’ সম্মানিত আমল লেখকবৃন্দ ‘ইয়ালামুনা মা- তাফআলুন’ তারা জানে তা তোমরা কর।
আবার যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কায়েম করে তাদের মধ্যেও এমন আছেন আত্ম অহমিকায় মন ভরে যায়। মনে করে সে নামাজ পড়ে কিন্ত আরেকজন পড়ে না। তাকে বে-নামাজী বলে তার সাথে খাওয়া তো দুরের কথা, কথা পর্যন্ত বলে না।
এমন অধিকারও তো ইসলাম দেয়নি।
লকডাউনের প্রথম দিকে সারাবিশ্বে অদৃশ্যমান প্রাণঘাতি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বে মৃত্যুহার তখন বেড়েই চলছিল। যা কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছিলো না। সরকার বাধ্য হয়ে মসজিদে মুসল্লীদের সংখ্যা নির্ধারন করে দিলেন। সম্ভবত এমন সময় রমজানের প্রথম দশদিনের (রহমতের দিন) কোনো এক জুম্মার নামাজের জন্য মসজিদে যাচ্ছিলাম। দেখি, লোকজন ছুটাছুটি করে মসজিদে ডুকছে। আমি অবশ্য স্বাভাবিক গতিতেই যাচ্ছিলাম। কাছে গিয়ে দেখি বাহিরে লোহার গেইট লাগানো। ততক্ষনে জামাত শুরু হয়ে গেছে। আমি বাধ্য হয়ে ফেরত আসলাম, আমার মতো অনেকেই ফেরত গেলেন। শুরুতে প্রশ্ন ছিল, আমার স্ত্রী নামাজ এতো তাড়াতাড়ি শেষ, আসলে তো আমি ঐ দিনের জন্য নামাজ আদায় করতে পারিনি। স্বাভাবিক রীতিতে ঘরের মধ্যে জোহরের নামাজ আদায় করলাম। আমার ছোট্ট জীবনে প্রথমবার এমন একটি ঘটনার মুখোমুখি হয়ে গেলাম। ঐদিন অনেক কষ্ট হয়েছিল, কেন এমন হলো? একেতো রমজান মাস আবার রহমতের দশ দিনের প্রথম শুক্রবার । এদিনে আল্লাহর কাছে আমার অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু পারলাম না।
হাদিসে উল্লেখ আছে, জুম্মার দিন মসজিদের দরজার পাশে দুজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকে। যারা প্রথম আগমনকারী থেকে শুরু করে উট, গরু, দুম্বা কোরবানি দেয়ার মতো অনেক সওয়াব আমলনামায় লেখা হয়। মুরগীর ডিম ছদকা করার মতো সওয়াব থাকে শেষসময়ে উপস্থিত হন এমন মুসল্লীদের জন্য। এখন উট কোরবানী তো দুরের কথা ডিম ছদকা করার মতো সওয়াব আমার ভাগ্যে হয়ে উঠলো না। আমার মনে হলো মসজিদে সরকারী বিধি নিষেধ নয় স্বয়ং আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করছেন। আমরা যারা ঠুনকো নামাজী , ঠুনকো ঈমানদার তাদেরকে মসজিদে ডুকতে দিচ্ছেন না তার সাথে সাক্ষাৎ করা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মৃত্যুর ভয়েই হোক, করোনার ভয়েই হোক, কবরের ভয়েই হোক। যখন বিধি নিষেধ আরোপ হলো তখন মানুষ বেশী বেশী মসজিদ মুখী হওয়া শুরু করলো। অনেকে বলে আল্লাহর মসজিদে ভাইরাস ঢুকবে কেন? মসজিদে যদি মশা ঢুকতে পারে তাহলে ভাইরাসও ঢুকতে পারবে।
মোটকথা হলো, জনসমাবেশ যেখানে বেশী হবে সেখান থেকেই এর বিস্তার ঘটতে পারে। এদিকে যখন বিধি নিষেধ উঠিয়ে নেওয়া হলো তখন কোন এক ফজরের নামাজে মসজিদে গিয়ে দেখি, আমি আর ঈমাম সাহেব ব্যতীত আর কেউই নেই। এখন নামাজ পড়েতে হলে ইকামত দিতে হবে। ইকামত দেয়ার অভ্যাস আমার নেই। মসজিদে বসেই মনে মনে ইকামত প্রেকটিস করলাম। নামাজের ঠিক আগ মুহুর্তে আরো একজন আসলো, শেষ পর্যন্ত ইকামত দেওয়ার কাজটা উনিই করলেন।
যে মসজিদে জুম্মার দিনে একটু পরে গেলেই নামাজে বসার জায়গা হয় না সেখানে ফজরের নামাজে ইকামত দেওয়ার মতো লোক মিলে না। মসজিদে নববী, মসজিদে হারাম, মসজিদে আকসার মতো লাখো লোকের সমাবেশ না ঘটলেও বৃহৎ আকারে বড় মসজিদ গঠন করি। যেখানে হাজার-হাজার লোকের সমাবেশ ঘটবে। অন্ততপক্ষে শুক্রবার জুম্মার দিনকে যাতে সত্যিই ঈদের দিন মনে হয় এবং গরীবের হজের দিন হয়।
লেখক: মো. রমজান আলী মিয়া
ট্রাফিক ইন্সপেক্টর,
সুনামগঞ্জ জেলা, ট্রাফিক বিভাগ
আনন্দবাজার/শাহী/নাহিদ