ফজলে রাব্বি ফরহাদ
সবুজ শ্যামল ঘেরা মায়াভরা অপূর্ব এক লীলাভূমির নাম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়ে দেশটি আজ স্বাধীনতার ৪৯ বছর অতিবাহিত করছে। এই ৪৯ বছরে ছোট্ট এই সবুজ দেশটি অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েছে। অনেক উন্নতির ছোঁয়া পেয়েছে আবার কোথাও সফল হতে হতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর মাঝেও কোথাও যেন এক অদৃশ্য শত্রু ওৎ পেতে কাজ করতেছে যেটা আমাদেরকে অন্যান্য জাতি থেকে পিছিয়ে রাখছে, যেই শত্রু পাকিস্তানি কিংবা বৃটিশদের থেকে কোন অংশেই কম নয়। সেই শত্রু আর কেউ নয়, সেটা হলো বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরের কর্মচারী, কর্মকর্তা ও প্রশাসনের মাথায় ঝোঁক মেরে বসে থাকা দুর্নীতি।
দুর্নীতিকে যদি আমরা একটু বিশ্লেষণ করি তখন আমরা জানতে পারি দুর্নীতি শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছেন এরিস্টটল তারপর সিসারো। এটাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক মরিস লিখেছেন, দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কাফম্যান বলেন, আইনানুগ দুর্নীতি শব্দটি যোগ করার মাধ্যমে যেখানে আইনকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করা হয় যাতে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ক্ষমতা আইন প্রণেতার নিকট রক্ষিত থাকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ( টিআই ) এর মতে, দুর্নীতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। টিআই এর সর্বশেষ জরিপে দুর্নীতির শীর্ষতায় যেই তালিকা প্রকাশ পেয়েছে সেটাতে বাংলাদেশর অবস্থান ১৪তম।
দুর্নীতির কোন একক কারণ নেই। এই দুরারোগ্য অভিশাপ দুর্নীতির কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে আপনি কারণ হিসেবে পাবেন ভোগবাদী মানসিকতা ও অভাবকে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে চিন্তা করলে এটা আপনার নিকট পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, অভাব নয় বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভোগবাদী মানসিকতাই দুর্নীতির প্রধানত কারণ। আজ দেশের প্রতিটি স্তরে ঘুষের আদান-প্রদান বিদ্যমান। যারা ঘুষ দেয় তারা হয়তো অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্য হয়েই দিতে হয় কিন্তু যারা এই ঘুষ দিতে সাধারণ জনগণকে বাধ্য করে তারা এটা করে তাদের বিলাসিতাপূর্ণ ও উচ্চাভিলাষী জীবন যাপনের মনোভাবের কারণে। আপনি এই দুর্নীতির পিছনে আরো কারণ তল্লাশি করলে খুঁজে পাবেন সুশাসনের অনুপস্থিতি, নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ বিবর্জিত রাজনীতি, স্বার্থপরতা ও স্বজনপ্রীতি, প্রকৃত শিক্ষার অভাব, জবাবদিহিতার অভাবসহ আরো নানাবিধ কারণ।
আজ আমরা দেখতে পাই যে, প্রতিবছর হাজরো শিক্ষিত গ্রাজুয়েট চাকুরীর ময়দানে যোগদান করে। কিন্তু পরবর্তীতে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, তাদের অধিকাংশই দুর্নীতির সাথে জড়িত। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন উত্থিত হয় যে, শিক্ষিতরা দুর্নীতিতে জড়িত কেন? এটার সোজাসুজি উত্তর হলো এটাই যে, তারা শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যার জ্ঞানেই শিক্ষিত বরং শিক্ষার যে প্রধান উদ্দেশ্য নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের জ্ঞান অর্জন করা সেটা তারা অর্জন করতে সক্ষম হয় নি। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থা কি পারবে এই দায় এড়াতে?
এক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো জবাবদিহিতার অভাব ও আদর্শ বিবর্জিত রাজনীতি। আমার ব্যক্তিগতভাবে কেন জানি মনে হয় এই দুটি কারণ বর্তমান বাংলাদেশের সিচুয়েশনে অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যারা আদর্শহীন রাজনীতি করবে তাদের দ্বারা যে কোন অপকর্মই সংগঠিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু তার সাথেই যদি যুক্ত হয় জবাবদিহিতার অভাব তাহলে তো আর কথাই নেই। যেটা বাংলাদেশের বর্তমান সিচুয়েশন অহরহ দৃশ্যমান। যেটা জন্ম দিচ্ছে জিকে শামীম, সম্রাট, পাপিয়া, সাহেদ ও ডাঃ সাবরিনাদের।
বর্তমান বাংলাদেশেে দুর্নীতির যে অবস্থা সেটা যদি আমরা দ্রুত সমাধান না করতে পারি তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম থেকে আমরা ভালো কিছু আশা রাখতে পারি না। এই অভিশপ্ত দুর্নীতির হাত থেকে মুক্তি পেতে আমাদের সরকার এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং করছে। কিন্তু সত্যিকারার্থে আমরা নিজেরা যতদিন না এটা থেকে সচেতন না হচ্ছি ততদিন এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। সেক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অধিক প্রসার, নামমাত্র শিক্ষা অর্জন না করে বরং শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জন, রাষ্ট্র কতৃক আমাদের জনপ্রতিনিধি ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ জবাবদিহি, আদর্শের রাজনীতিকে নিশ্চিত করতে হবে। তবেই রাষ্ট্র, দুদক ও আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই দুরারোগ্য অভিশাপ দুর্নীতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভবপর হবে। তখনই আমরা উচ্চকণ্ঠেে ঘোষণা দিতে পারবো আমাদের দেশ সোনার বাংলাদেশ। তখনই সারাবিশ্বের নিকট বাংলাদেশ উত্থিত হবে এক রোলমডেল হিসেবে।
লেখক: ফজলে রাব্বি ফরহাদ
লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
আনন্দবাজার/শাহী/ফরহাদ