অধ্যাপক ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির
১. উপক্রমণিকা
বাংলাদেশের মন্ত্রী-পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী হলো―সরকার প্রধান। প্রধানমন্ত্রী চলেন মন্ত্রী, সচিব ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের পরামর্শে। অর্থাৎ তিনি কোন কিছু করতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেন নিজে, কিন্তু চিন্তার যোগান দেন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ যাঁদেরকে বলা যেতে পারে চিন্তক-বর্গ (যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো- thinktank)। এই চিন্তক-বর্গের মধ্যে চিন্তায় বৈপরীত্য প্রায়ই চোখে পড়ে। এই বৈপরীত্যের অন্যতম হলো―ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে বৈপীরিত্য। এই বৈপরীত্য সর্বপ্রথম চোখে পড়ে, যখন প্রধানমন্ত্রী বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে প্রচলনের জন্য আবদার জানান। এই নিবন্ধে এই বৈপরীত্যের চালচিত্রটি তুলে ধরা হবে এবং তা থেকে উদ্ভূত ভাষা-সাংস্কৃতিক সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে পর্যালোচনা করা হবে।
সাধারণভাবে আমরা জানি যে, ভাষা একটি সংজ্ঞাপনের মাধ্যম। কিন্তু ভাষা শুধু একটি সংজ্ঞাপনের মাধ্যম নয়। সাধারণ মানুষ ভাষাকে একটি সংজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসাবে বুঝলে কোন সমস্যা নেই। সাধারণ মানুষের এতো কিছু বুঝার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর চিন্তক-বর্গ যখন ভাষা কী― তা যদি ভালো করে না বুঝেন, তাহলে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন যৌক্তিক ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত পারবেন না। বিষয়টির গভীরে যাওয়ার পূর্বে- ভাষা যে কী তা নিয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।
২. ভাষার স্বরূপ সম্পর্কে বিভ্রান্তি
ভাষা হলো― একটি সংযুতিপ্রসূত সংজ্ঞাপনের মাধ্যম যা প্রেক্ষাপটভেদে নানারকম প্রভাবক হিসাবে অবতীর্ণ হয়। এটি একদিকে জাতীয়তাবাদীদের কাছে যেমন জাতীয়তাবাদ ও সভ্যতার প্রতীক, আবার অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে এটি হলো― সাম্রাজ্যবাদের অস্ত্র বিশেষ, যার মাধ্যমে অনুবর্তী দেশের সমাজ-সংস্কৃতির উপর প্রভাব বিস্তার করা যায়। সে বিবেচনায় ইংরেজি ভাষা হলো―আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার হাতিয়ার বিশেষ, আর বাংলা ভাষা হলো―দেশের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার ব্যুহ বিশেষ।
আমাদের দেশের কিছু মানুষের কাছে ইংরেজি ভাষা কোনো সংস্কৃতির বিষয় নয়, বরং তাঁদের কাছে এটি হলো―ক) উচ্চশিক্ষার একটি মাধ্যম, খ) আভিজাত্যের প্রতীক, গ) জ্ঞান-গর্বের প্রতীক, ঘ) পাশ্চাত্যে অভিবাসনের সুযোগ ও ঙ) সামাজিক গতিশীলতার সিঁড়ি বিশেষ। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো―ক) বৃহত্তর জাতীয় সমাজে আত্তীকরণের মাধ্যম, খ) সামাজিকীকরণের মাধ্যম, গ) জাতীয়তাবাদের প্রতীক, ঘ) সভ্যতার বাহন, ঙ) সামাজিক সম্পদ ও চ) সাংস্কৃতিক সম্পদের নিয়ামক। অপরপক্ষে, সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা হলো ―ক) ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার, খ) অন্যের সংস্কৃতিকে কলুষিত করার হাতিয়ার, গ) অন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে পরাধীন করার হাতিয়ার বিশেষ।
৩. ভাষার উপযোগিতা সম্পর্কে চিন্তক-বর্গের উদ্যাসীন্য
ভাষার উক্ত বহুরূপ উপযোগিতা সম্পর্কে বাংলাদেশে রাষ্ট্রের চিন্তক-বর্গ ওয়াকিবহাল রয়েছেন বলে মনে হয় না। কেননা, চিন্তক-বর্গ দেশের নানান নীতি, যেমন- পাটনীতি, অর্থনীতি, পানিনীতি ও শিক্ষানীতি ইত্যাদি নিয়ে সরব থাকলেও, ভাষানীতি নিয়ে নীরব রয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে এই ভাষানীতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চিন্তক-বর্গের মধ্যে কোনরূপ আফসোস বা উপলব্ধিও নেই। ভাষানীতি সম্পর্কে তাঁদের এই নির্লিপ্ততার কারণ হলো―ক) ভাষিক ইতিহাস ও ভাষা পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞতা, খ)পাশ্চাত্যায়নের প্রতি অন্ধ লোলুপতা ও গ) ইসলামায়নের প্রতি মোহাবিষ্টতা। ইসলামায়নের প্রতি মোহাবিষ্টতা যতোটা না ভাষানীতি প্রণয়নে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে, তার চেয়েও বেশি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে পাশ্চাত্যের প্রতি অন্ধ লোলুপতা।
৪. দেশের ভাষা-সাংস্কৃতিক সমস্যার চালচিত্র
যদিও রাষ্ট্রের চিন্তক-বর্গের নজরে আসছে না, কিন্তু দেশে একটি বিপজ্জনক ভাষা পরিস্থিতি বিরাজিত রয়েছে এবং এই ভাষা পরিস্থিতি দিনের পর দিন বদলাচ্ছে। আর এই বিপজ্জনক ভাষা পরিস্থিতির সুযোগে দেশের ভাষা-সাংস্কৃতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, যার ভবিষ্যৎ পরিণতি হতে পারে জাতীয় অসংহতি।
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার কন্দ্রস্হলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আবাসস্থল। কিন্তু রাজধানীতে অবস্থিত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আবাস্থলকে ঘিরেই বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংসের ইংরেজি নামক বিষক্রিয়ার পরিব্যপন শুরু হয়েছে। এই বিষক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায়, যা প্রতিভাত হচ্ছে, তা হলো―রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর আবাসকে ঘিরে অবস্থিত ক) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে সর্বত্র ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, খ) বেসরকারি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত হচ্ছে, গ)অধিকাংশ মানুষ লেখ্যভাষা হিসাবে ইংরেজি ও বাচ্যভাষা হিসাবে বাংলা-ইংরেজি মিশেল ভাষা ব্যবহার করছে।
৫. ভাষা-সংস্কৃতি চিন্তায় বৈপীরিত্য যেভাবে আন্তর্জাতিক মাত্রা পেলো
দেশে যে উক্ত ভয়াবহ ভাষা-সমস্যা বিরাজিত রয়েছে, সে সম্পর্কে প্রধান-মন্ত্রীর চিন্তক-বর্গ ওয়াকিবহাল নয়। যদি তাঁরা ওয়াকিবহাল থাকতেন, তাহলে তাঁরা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পরামর্শ যোগাতেন। কিন্তু তাঁরা সেটা না করে বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে চালুর উদ্যোগ নিতে তৎপর হয়ে উঠেন। এই তৎপরতার অংশ হিসাবে গত ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের ভাষা হিসাবে চালুর ব্যাপারে আবদার জানান। জাতিসংঘ তার জবাবে জানতে চায় যে, জাতিসংঘে বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে চালু করতে ও চালু রাখতে প্রয়োজনীয় খরচ কে যোগাবে। এই খরচের প্রশ্নেই প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ইতি ঘটে। তারপর আর কিছু হয়নি। কিন্তু বৈপরীত্যটা হলো এই যে―যে দেশের রাজধানীতে মানুষ নিজের দেশের ভাষা ঠিকমতো ব্যবহার করে না, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী তার সেই ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে চালু করার প্রস্তাব দেন।
ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কিত চিন্তায় বৈপরীত্য থেকেই এই ধরণের দ্বিচারিতার জন্ম হয়েছ বৈ-কী? কিন্ত এই বৈপরীত্য নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাপ্রসূত বিষয় নয়, বরং এই বৈপরীত্য হলো―প্রধানমন্ত্রীর চিন্তক-বর্গের চিন্তা প্রসূত বৈপরীত্য। আর এ রকম শত বৈপীরত্যের ঝঞ্জাটেই চলছে দেশ। আর ইংরেজি ভাষার বিষক্রিয়ায় দেশের ভাষা-সংস্কৃতি কলুষিত হচ্ছে।
৬. ভাষা-সাংস্কৃতিক সংকট বিমোচনে করণীয়
দেশের চিন্তক-বর্গের বৈপরীত্যপূর্ণ চিন্তার কবলে পড়ে দেশের ভাষা-সংস্কৃতি মহাসংকটে নিপতিত হয়েছে। ভাষা-সংস্কৃতির এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে দেশে একটি যুগোপযোগী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এই ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নে প্রয়োজন একটি ভাষানীতির, যেখানে দেশের ভাষা সমস্যার সমাধান ও জাতি গঠনের এ প্রয়োজনে বিভিন্ন ভাষাকে তার গঠন, মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা অনুসারে আনুপাতিক হারে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এই ভাষানীতিতে শিক্ষাব্যবস্থায় নিচের ভাষাগুলো অন্তুর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
ক) দেশের ভাষা-সংস্কৃতিকে সুরক্ষার প্রয়োজনে জাতীয়তাবাদের প্রতীক, জাতীয় সংস্কৃতির বাহক ও সামাজিকীকরণ ও বৃহত্তর সমাজে আত্তীকরণের নিয়ামক জাতীয় ভাষাকে বাধ্যতামূক বিষয় হিসাবে শিক্ষাব্যবস্থায় চালু করণ। খ) জাতীয় ইতিহাসের শেকড় সন্ধানে আরবি, ফার্সি, পালি ও সংস্কৃত ইত্যাদি ধ্রুপদী ভাষাকে শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গীভূত করণ, গ) বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সুবিধা থেকে জাতিকে সমৃদ্ধ করতে বিভিন্ন বিদেশী ভাষাকে আনুপাতিক হারে গুরুত্ব দিয়ে সমস্ত বিদেশী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় এমনভাবে অঙ্গীভূত করণ যেন চীনা, জাপানি, ফরাসি, জার্মান, স্পেনীয় ইত্যাদি ভাষাসমূহ ইংরেজির সমান গুরুত্ব পায়। এই ব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষা কেন্দ্রিক বিদেশী ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার নাগপাশ থেকে মুক্তি ঘটবে।ফলশ্রুতিতে বর্তমানে বাংলাদেশের ভাষা-সাংস্কৃতিক সংকট থেকে মুক্তি ঘটবে। আর চিন্তক-বর্গের বৈপরীত্যময় চিন্তা থেকে দেশের ভাষা-সাংস্কৃতিক সংকটের মহামুক্তি ঘটবে।
লেখক: অধ্যাপক ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির
জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ
ই-মেইল: razaul_faquire@du.ac.bd
আনন্দবাজার/শাহী