ঢাকা | রবিবার
২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১২ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সমালোচনা সহজ, কাজ করা কঠিন

মো. জামাল হোসেন

একজন ভবঘুরে সবসময় রাজাকে গালিগালাজ করতো। আর রাজার কর্মকাণ্ড নিয়ে খুব সমালোচনা করতো। রাজ্যের সকল শ্রেণির লোকদের কাছে গিয়ে সমালোচনা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। কখনো ব্যবসায়ীদের কাছে, কখনো চাকরিজীবীদের কাছে, কখনো শ্রমিকদের কাছে- এসব করে করে সে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করলো।

একদিন একজন গিয়ে পুরো ব্যাপারটা রাজাকে জানাল। রাজা গভীর মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলো। পুরো ঘটনা শুনে রাজা ওই ভবঘুরে ব্যক্তিকে রাজ দরবারে হাজির করার নির্দেশ দিল। যথারীতি ভবঘুরে ব্যক্তিকে রাজ দরবারে হাজির করা হলো।

রাজা ভবঘুরে ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলো- যা শুনছি তা সঠিক কীনা? ভবঘুরে ব্যক্তি উত্তর দিল- সঠিক শুনেছেন। তখন রাজা ভবঘুরে ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলো- তোমার সমস্যা কী? ভবঘুরে ব্যক্তি বললো- আমার কোন সমস্যা নাই, রাজ্যের সমস্যাই আমার সমস্যা। রাজা কথা শুনে হাসতে লাগলো। রাজা ভবঘুরে ব্যক্তির কাছে রাজ্যের সমস্যা জানতে চাইলো।

তখন ভবঘুরে ব্যক্তি রাজ্যের সমস্যা বলতে শুরু করলো- আমরা কর দেই, তবে কোন সুবিধা পাই না। সব সুবিধা তো আপনি ভোগ করেন। রাজ্যে কৃষকের সমস্যা আছে, ব্যবসায়ীদের সমস্যা আছে। পানির সংকট রয়েছে। চিকিৎসা ও খাদ্যের সমস্যা আছে। এছাড়া আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। রাজা হাসতে হাসতে ভবঘুরে ব্যক্তিকে বললো, তোমাকে যদি রাজা বানিয়ে দেই তুমি কী পারবে এই সমস্যা সমাধান করতে। ভবঘুরে ব্যক্তি বললো, অবশ্যই পারবো।

রাজা তখন ভবঘুরে ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলো- তা তুমি কয়দিন সময় নিবে? বললো- এক মাস সময় দিলেই হবে। রাজা তখন হাসতে হাসতে ভবঘুরে ব্যক্তিকে ৬ মাস সময় দিলেন। আর ভবঘুরে ব্যক্তিকে বললো- তোমার এতো সমস্যা সমাধানের দরকার নাই, তুমি শুধু কৃষকের সমস্যাটাই সমাধান করো আর রাজ্যে খাদ্যের ব্যবস্থাটাই করো।

ভবঘুরে ব্যক্তি হাসতে হাসতে বললো, ৬ মাসে আমি সকল সমস্যাই সমাধান করতে পারবো। পুরো রাজ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষনা দেয়া হলো অমুকদিন থেকে এই ভবঘুরে ব্যক্তি এই রাজ্যের রাজা হিসাবে রাজ্য চালাবেন।

রাজ্যে ঢাকঢোল পিটিয়ে ভবঘুরে ব্যক্তিকে রাজা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। রাজ্যের সবাই বেজায় খুশি। সবাই মনে করলো, এবার হয়তো উনি সবার জন্য কিছু করতে পারবে। নতুন রাজা চেয়ারে বসে ঘোষণা করলেন, রাজ ভোজ আর শাহী খাবার আয়োজন করা যাবে না। সে যতোদিন থাকবে সাধারণ খাবার গ্রহণ করবে এবং পোশাক পরবে সাধারণ মানুষের। এতে কিছুটা বাহবা কুড়ালো সে।

সে তার নতুন মন্ত্রীপরিষদ গঠন করলো। যাদের কাছে গিয়ে সমালোচনা করতো তাদের নিয়ে। ভিখারি থেকে ব্যবসায়ি সবার প্রতিনিধি রাখলো। বলে রাখা ভালো, একটা র্শত দেয়া হয়েছিল নতুন রাজার জন্য। শর্তটা হলো, সে রাজকোষ থেকে কোন টাকা খরচ করতে পারবেনা। যেহেতু সে নতুন রাজা তার রাজস্ব নতুন করেই সংগ্রহ করতে হবে। সে ৬ মাসে যা রাজস্ব আরোহণ করবে এবং খরচ করবে তা পুরোনো রাজকোষ থেকে সমন্বয় করে দেওয়া হবে এবং পুরোনো রাজা তিন মাসের অগ্রিম বেতন দিয়ে দিয়েছিল রাজ্যের সব র্কমচারীকে। তাই নতুন রাজাকে যেন চিন্তায় পড়তে না হয়।

নতুন রাজা খাজনা আদায়ে মনোযোগি হলো। প্রথমইে খাজনা আদায় করতে গিয়েই ঘটলো বিপত্তি। উনি যেহেতু বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকদের সাথে উঠাবসা ছিলো তাই উনি জানতো কার ব্যবসায় কতো লাভ। কিন্তু রাজস্ব আহরণের সময় দেখে সব শ্রেনি পেশার লোকজনই রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছ। যে কৃষকের বছরে দশ মণ ধান হওয়ার কথা সে তার হিসাবে দেখাচ্ছে দুই মণ ধান। যে ব্যবসায়ী বছরে দশ টাকা আয় সে দেখাচ্ছে দুই টাকা। দেখতে দেখতে ৩ মাস পার হয়ে গেলেও রাজস্ব আদায় কাঙ্খিত পর্যায়ে গেল না। রাজ্যের সমস্ত কর্মচারীকে বেতন দেওয়ার পর রাজকোষে কিছুই রইলোনা।

এদিকে রাস্তাঘাট, পানির সমস্যা, স্বাস্থ্যখাত পুর্নগঠন করবে কিভাবে। সব খাতেই এক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। যারা একদিন তাকে সাধুবাদ দিতো তারাই তার সমালোচনা শুরু করলো। আবার পাশের রাজ্যের রাজারাও তার রাজ দরবারের প্রতি খেয়াল রাখছিল। পাশের রাজ্যের রাজারা তার খাবার, পোশাক দেখে মনে করলো এই রাজা গরিব। তাই তাকে ধাক্কা দিয়ে তার রাজ্য দখল করে নেওয়া যাবে।

অন্যদিকে প্রজাবিদ্রোহ হয়ে গেল। রাজ্যের কিছু স্বনামধন্য প্রজাকে খবর পাঠানো হলো আলোচনা করার জন্য। তো প্রজারা আসলো রাজার সাথে আলোচনা করার জন্য। তাকে সবাই ব্যর্থ রাজা হিসেবেই ভৎসনা করলো। তখন রাজা প্রজাদের উদ্দেশে বললো- শুনুন প্রজাগণ অনেক আশা নিয়ে এই রাজ্যের রাজা হয়েছিলাম আমি আপনাদের উপর ভরসা করে। কিন্তু আপনারা তো সঠিকভাবে খাজনাই প্রদান করেন না। তাহলে আমি তো অযোগ্য হবোই। আর অনুতপ্ত হয়ে বলছি- সমালোচনা করা সহজ, আর কাজ করা কঠিন।

পুরান রাজার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় রাজ্যের আয় ব্যয়ের হিসাব তুলে ধরা হলো। নতুন রাজার ছয় মাসে যা আয় হয়েছে তা বেতন ভাতা, উন্নয়নমূলক র্কমকাণ্ডে খরচ দেখানো হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নমূলক র্কমকাণ্ডের জন্য যা দেওয়া হয়েছিল তা মাঠে যেতেই শেষ। নতুন রাজা যাকে যেখানে দায়িত্ব দিয়েছিল তারাই সব খেয়ে ফেলেছে।

ভবঘুরে রাজা ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে তার আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত সব র্কমচারীদের জেলে পুরে দিলো এবং সে নিজেও জেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তার কাজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলো। আর রাজাকে বলে গেলো, হুজুর সমালোচনা করা সহজ কিন্তু কাজ করা কঠিন। আর চুরি করার পর চোর ধরে লাভ নেই। চুরি হওয়ার আগে চুরি বন্ধ হওয়ার উপায় বের করতে হবে।

এবার আসি মূল পর্বে। আমরা আমাদের দিকে তাকাই। নোংরা রাজনীতির কবলে দেশ। শুধু সমালোচনা আর সমালোচনা। কেউ সমাধানের পথ দেখায় না। গঠনমূলক সমালোচনা করা একটা রাষ্ট্রের জন্য ভালো। কিন্ত অপপ্রচারে যেন আমরা কান না দেই সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অপপ্রচার করে পচাত্তরের ১৫ আগস্ট সংগঠিত করা হয়েছিল। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার জন্য অপপ্রচারকে হাতিয়ার হিসাবে বানালে তা কোন রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেনা। এটি ৭৫ ও ২০০১ পরবর্তী সময়ে এই জাতি হারে হারে টের পেয়েছে।

এখন দেখা যায়, সরকারের ভালো কাজের সমালোচনা করা হয়। আবার খারাপ কাজেরও সমালোচনা করা হয়। ভালো আর খারাপ কাজ গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। আর তাই রাষ্ট্রের যারা ভালো কাজের সাথে জড়িত তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে ভালো কিছু করার।

কাজ করলে সমালোচনা হবেই সমালোচনা গ্রহণ করেই এগিয়ে যেতে হবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে কাজ সবাই সঠিকভাবে পালন করলেই হয়তোবা দেশ এগিয়ে যাবে। যেহেতু দুর্নীতি এই উপমহাদেশের একটা বড় সমস্যা তাই আগে বের করতে হবে কিভাবে দুর্নীতি কমানো যায়। দুর্নীতিবাজদের বিচার করে কখনো দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।

রাবনের দশ মাথা কাটলে আরেক মাথা আসে। তাছাড়া মাথাব্যথার ওষুধ কখনোই মাথা কেটে ফেলা নয়। ওষুধ দিয়েই মাথাব্যথা সারতে হয়। যেহেতু সমালোচনা আছে রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায় দুর্নীতি হচ্ছে, তাই সরকারের উচিত কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা।

দুর্নীতি দমন কমিশন ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে প্রতিটি সংস্থায় একটা করে সেল গঠন করতে হবে। সেই সেলে প্রকৌশলী, ডাক্তার, কারিগরী, পুলিশ ও সাংবাদিক- সমন্বয় করে নিয়োগ দিতে হবে। এটি পুরোটাই দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে হবে এবং পুরো স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এই সেলকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে কার্যক্রম পুরোটাই প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নিয়ন্ত্রিত হতে হবে ।

প্রতিটা সংস্থায় এমন করে একটা সেল গঠন করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের এই সেলের প্রত্যয়ন ছাড়া কোন প্রকল্প পাস হবে না। একইভাবে প্রত্যয়ন ছাড়া কাউকে বিল দেওয়া হবে না। কেউ যদি মনে করে এখানে দুর্নীতি হয়েছে তার সমস্ত দায়ভার ওই সেলের নিতে হবে। এরকম করে প্রতিটা উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিটা সেক্টরে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে একটা করে সেল গঠন করে দিতে হবে।

যদি ওই জায়গায় কোন দুর্নীতি হয় দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত সেলের উপর সমস্ত দায়ভার পড়বে। এজন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিসিএস ক্যাডার, ব্যাংকার ও পুলিশ আলাদাভাবে নিয়োগ দিতে হবে।

রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে নির্দিষ্ট পরিমাণে জরিমানা করে দুর্নীতিবাজদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা যেতে পারে। একটি নির্দিষ্ট সময় দিয়ে এবং তাদের থেকে অঙ্গীকার নেওয়া যেতে পারে। তাহলে তারা আর কোনদিন দুর্নীতি করবেনা বরং তারা দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়তা করবে। কারণ তারা জানে কিভাবে অসৎ উপায়ে সম্পদ অর্জন করা যায় আর ওই উপায়ের তথ্যগুলো তারা দুর্নীতি দমন কমিশনকে দিয়ে তাদের সহযোগিতা করবে। আর ক্ষমার আওতায় আনাদের আর যাতে হেনস্তা না করা হয়, সেটির জন্য আইন পাস করতে হবে। তাহলে এমনিতেই অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে।

দুর্নীতি হওয়ার পর দুর্নীতি ধরে লাভ নাই। কারণ এটির বিচারকার্য হতে কমপক্ষে ২০ বছর লেগে যায়। তাই দুর্নীতি হওয়ার আগে দুর্নীতিরোধ করলেই মনে হয় ভালো।

লেখক :
মো. জামাল হোসেন
সম্পাদক
দৈনিক আনন্দবাজার

সংবাদটি শেয়ার করুন