ঢাকা | শুক্রবার
৩১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১৫ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দুনিয়াতেই শেষ বিচার দিনের আওয়াজ ‘ইয়া নাফসি’

মো. জামাল হোসেন

শেষ বিচার দিনে সবাইকে যখন বিচারের মুখোমুখি করা হবে তখন সবার মুখে একটাই আওয়াজ হবে- ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি। কঠিন সেই সময়ে কেউ কারো দিকে তাকানোর ফুসরত পাবে না। মা তাঁর গর্ভের সন্তানকে চিনবে না। সন্তান জন্মদাত্রী মাকে চিনবে না। পিতা প্রিয় সন্তানকে চিনবে না। সন্তান শ্রদ্ধেয় পিতাকে চিনবে না। স্বামী প্রিয়তম স্ত্রীকে চিনবে না। স্ত্রী প্রাণের স্বামীকে চিনবে না। স্বার্থপর কথা মনে হলেও সবার অব্যক্ত উক্তি- ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি।

কিয়ামতের আগেই কিয়ামতের আলামত। সেই আলামতের নাম- করোনাভাইরাস। সামাজিক বন্ধনই মানব সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার আসল শক্তি। করোনা থেকে বাঁচতে আজ সেই সামাজিক বন্ধন বিচ্ছিন্ন করতে হচ্ছে। সামাজিক বন্ধনহীন দুনিয়ায় থাকা আর না থাকা একই কথা।

সুন্দর দুনিয়া ত্যাগ করার আগে ভালোবাসার মানুষদের মুখ দেখে যেতে চাই। তবে করোনায় আক্রান্ত হলে হয়তো আর প্রিয়জনদের মুখ দেখা সম্ভব হবে না। নিজে খুব ভয়ে আছি। কিছু শারীরিক সমস্যা আমার আছে। কেবল আমি নই, সোনার বাংলার বেশিরভাগ মানুষই নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত। কেননা আমরা প্রতিনিয়ত ভেজাল খাবার আর দূষিত বাতাস গ্রহণ করছি।

অবশ্য এসবের জন্য আমরাই দায়ী- নিজেরাই প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি। কেউ বন কেটে উজাড় করেছি। কেউবা পাহাড় কেটে সমতল করেছি। কেউ আবার খাদ্যে রাসায়নিক মিশিয়েছি। সবকিছুতেই বিষের ছড়াছড়ি।

করোনা আলোচনায় আসার পরে আমার এক পরিচিতজন একটা মজার মন্তব্য করেছে। তাঁর ভাষ্য- ‘করোনায় আমাদের কিছুই হবে না’। আমি বললাম, ‘কেন’? সে বলল, ‘আমরা প্রতিদিন খাদ্য থেকে, বাতাস থেকে বিষ শরীরে গ্রহণ করছি। তাই করোনা আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে উল্টো নিজেই মারা যাবে’! তাঁর এই কথার যৌক্তিক কোন ভিত্তি হয়তো নেই। তবে এসব বিষয় আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে।

দেশে করোনায় আক্রান্তে মৃত্যুর সংখ্যা সরকারিভাবে পাঁচজন। এইসব মৃত ব্যক্তির লাশ ঢাকায় দাফন করতে দেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। সবার অব্যক্ত উক্তি- ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি।

ঢাকার একটি করবস্থানের গেইটে একটি ব্যানার টাঙানো হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি মেয়রের প্রতি আবেদন জানানো হয়- সাধারণ জনগণের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে ‘করোনাভাইরাস’ আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিদের লাশ খিলগাঁও তালতলা কবরস্থানের পরিবর্তে ঢাকার বাহিরে বা অন্য কোন নিরাপদ স্থানে দাফন করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করছি।

এটিকে মৃত ব্যক্তির লাশের সঙ্গে নির্দয় আচরণ বলে সমালোচনা করছেন অনেকে। তাঁরা বলছেন, মৃত ব্যক্তির লাশ যথাযথ প্রক্রিয়ায় দাফন করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আর দাফন কাজে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সরাসরি যুক্ত থাকে। তাহলে ভাইরাস ছড়ানো ঝুঁকি থাকে কেমনে? বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন।

আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ যেই এলাকায় দাফন করবে ওই এলাকায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি- এই আশঙ্কায় হয়তো এটা করা হচ্ছে। হয়তোবা আমি সেই এলাকার হলে আমার সিদ্ধান্তও এলাকাবাসীর পক্ষে যেতে পারতো। মানুষ বাঁচার জন্য খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। তবুও সবাই বাঁচতে চায়। সবার অব্যক্ত উক্তি- ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি।

আলেম সমাজ বলছে, মহামারীতে মারা গেলে মৃতব্যক্তিকে শহীদের মর্যাদা দেয়া হয়েছে ধর্মে। তাহলে কী করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি মরার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হলো? করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করা না গেলে পুরো পৃথিবী সন্দেহের দিকে ধাবিত হবে।

মা কষ্ট করে ১০ মাস ১০ দিন গর্ভেধারণ করে সন্তান জন্ম দেয়। সেই মা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে আদর করবে না। বাবা কষ্ট করে দিনরাত পরিশ্রম করে সন্তানের ভবিষৎ গড়ার চেষ্টা করে। সেই বাবা সন্তানকে কোলে বসিয়ে আর আদর করবে না। স্বামী তাঁর স্ত্রীকে এতো ভালোবেসে দুনিয়ার শত কষ্ট মাথায় নেয়- শুধু স্ত্রীর মুখের হাসির জন্য। সেই স্বামী-স্ত্রীর আর মিলন হবে না।

প্রেমিক-প্রেমিকা শপথ নেয় শত বাধাবিপত্তি হলেও দেখা করবে। ওরা আর হাত ধরে একসঙ্গে হাঁটবে না। এক অমানবিক দুনিয়ার কথা বলছি। বিপর্যয় আর ধ্বংসের দিকে যাবে। তবু বলতে চাই, আমাদের মমত্ববোধ মরেনি। যা বলছি তা নিছকই কল্পনা থাক। আসলে ওই আক্রান্ত মৃতব্যক্তির লাশ দাফন করতে দেয়নি ঠিকই, এলাকাবাসীর ঝুঁকির কথা ভেবে। নিশ্চিত ওই এলাকাবাসী মনে মনে দোয়া করেছে করোনায় মৃতব্যক্তির জন্য।

পুরো দুনিয়া এখন করোনার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। তাই করোনা যুদ্ধের শহীদদের জন্য ধর্মভেদে আলাদা সৎকারের ব্যবস্থা করা উচিত। এতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে কেন এরা শহীদ হয়েছিল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেই এরা শহীদ হয়েছে- এটা জানলে সচেতন হবে টিকে থাকা আগামী প্রজন্ম।

আবারো ভালোবাসার কাছে ফিরি। এই দুনিয়ার একমাত্র সুখই ভালোবাসা। মা সন্তানকে স্পর্শ করছে না, বাবা সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করছেন না- কেবল কলিজার টুকরাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এটিই ভালোবাসা। স্বামী তাঁর স্ত্রীকে স্পর্শ করছে না- কেবল দুজন দুজনকে বাঁচিয়ে রাখতে। এটিই ভালোবাসা। প্রেমিক তাঁর প্রেমিকার হাত ধরছে না- সুন্দর আগামীর জন্য। এটিই ভালোবাসা।

আল্লাহ না করুক কেউ আক্রান্ত হলে আমরা পালাই না- কেবল ভবিষৎকে দেখার জন্য আলাদা থাকি। আসুন সরকারি নির্দেশনা মেনে চলি। তাহলে হয়তোবা আমাদের কাউকেই এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত, গণপরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আক্রান্তদের হাসপাতাল, জনসচেতনতার জন্য প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করেছে। পরামর্শের জন্য ঘরে বসেই হটলাইনে কথা বলতে পারবেন। ঘর থেকে কেউ বের হবেন না। পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন থাকুন। আপনার প্রতিবেশিদের এটা করতে উৎসাহ দিন। আশার কথা, সরকারের পাশাপাশি অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও এই মহামারী ঠেকাতে কাজ করছে। তাঁদের জানাই স্যালুট। মানুষ মানুষের জন্য- এই সংকটে এটা ভুলে গেলে চলবে না।

জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ থাকবে সামনের দিনে- কোন দেশ প্রকৃতি ধ্বংস করলে ব্যবস্থা নিন। কোন দেশ খাদ্যে ভেজাল দিলে ব্যবস্থা নিন। এসব অপরাধী রাষ্ট্র যতো ক্ষমতাধর হোক না কেন- ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বমোড়লরা নিজেদের আধিপত্যের জন্য পারমানবিক অস্ত্র, জীবাণু অস্ত্র বানায়। মানুষই যদি না থাকে কার উপর আধিপত্য চালাবেন? এসব থেকে নিজেদের সরিয়ে নিন।

লেখক-
মো. জামাল হোসেন
সম্পাদক
দৈনিক আনন্দবাজার

সংবাদটি শেয়ার করুন