মো. জামাল হোসেন
কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো দুনিয়ার ঘুম কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস। বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা সমাজব্যবস্থা সবকিছু নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। করোনার সংকটে দেশের সরকার নিত্যনতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে সাধারণ জনগণের অসচেতনতা এবং উদাসীনতা দেশকে আরও হুমকিতে ফেলছে।
করোনা ঠেকাতে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি হয়তো ঠিক আছে। তবে একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে- সামাজিভাবেই সম্ভব এটির প্রতিরোধ। দিয়াবাড়িতে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার স্থাপন করতে না দেয়ার বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর আন্দোলনটি অবশ্যই অমানবিক। প্রকৃতি এমন নিষ্ঠুরতা সহ্য করে না। আমাদেরকে সামাজিকভাবে সহায়ক হতে হবে। সেটা দূরত্ব বজায় রেখে হলেও। গবেষণা বলছে, ভয় পেলে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা সমুচীন হবে না।
একটি বিষয় পরিস্কার, সরকারের একার পক্ষে করোনাভাইরাসের মতো সংকট কোনভাবেই মোকাবিলা সম্ভব না। এটি মোকাবিলা করতে চাই- সমন্বিত উদ্যোগ। আমাদের ১৬ কোটি মানুষের জনবহুল দেশ। জাতির এই গভীর সংকটের সময়ে দলমত, জাতপাত বাদ দিয়ে সমস্যা উত্তরণে সবাইকে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সবাই মিলে, সবার বিপদ- এই ভাইরাস মোকাবিলা করতে হবে। এমন সংকটকালীন সময়ে কোনরকম রাজনীতি করা যাবে না। একান্ত আন্তরিকতা নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
সাংবাদিকদের জড়ো করে প্রেস কনফারেন্স বন্ধ করতে হবে। এটিতে করোনাভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি আরও বাড়ে। আপদকালীন সময়ে গুজব ডালপালা ছড়ায়। এটি ঠেকাতে প্রচার প্রচারণা অবশ্যই দরকার আছে। তবে ঝুঁকি এড়াতে বিকল্প হিসেবে সাংবাদিক না ডেকে সরাসরি প্রেস রিলিজ প্রেরণের ব্যবস্থা করতে হবে। লোক দেখানোর জন্য রাস্তায় লোকজনের ভীড় বাড়িয়ে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ সুখকর নয়। এসব নিয়ে বাহবা কুড়াতে ছবি তোলে ফেসবুকে দেয়া বন্ধ করতে হবে।
গত কয়েক দিন ধরে দেখছি, কিছু নেতা করোনা ঠেকানোর উপকরণ বিতরণ করছে। এটি অবশ্যই ভালো। তবে বিতরণের সময় নিজেরাই কোন সুরক্ষা ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এটি নিয়ে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, যেটি যৌক্তিক। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব তামাশা নিয়ে হাসাহাসি করছে।
সারাদেশ এখন অনেকটাই লকডাউনের মতোই। ট্রেন, বাস এবং লঞ্চ চলাচল বন্ধের পথে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ছুটি হয়ে গেছে। সরকারি, বেসরকারি অফিস আদালতও বন্ধ হবে বৃহস্পতিবার থেকে। রাজধানীসহ বেশ কিছু এলাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং ওষুধের দোকান ছাড়া সব বন্ধ। অনেক গ্রামীণ হাটও বন্ধ হয়ে গেছে- এমন খবর আসছে গণমাধ্যমে। তবে এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপত্তিতে পড়তে শুরু করেছে দিন আয়ে দিন খায় অথবা অল্প আয়ের মানুষ।
মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য- এটি আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর, সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলর, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের দায়িত্ব অনেক বেশি নিতে হবে।
এসব কার্যালয় থেকে বিনামূল্যে খাদ্য ও ওষুধ বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও দেশের বাস্তবতায় এটি কাল্পনিক, তবে অসম্ভব না।
যারা ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করতে চান তাঁরা এসব কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিবেন। এখান থেকেই সুরক্ষিতভাবে বিতরণ করা যেতে পারে। এতে করে সব এলাকার মানুষ সহায়তা পাওয়ার পাশাপাশি বিশৃঙ্খলা এড়ানো সম্ভব। অনেক দুর্যোগে আমরা দেখেছি, একই এলাকায় অনেকেই খাবার দিয়েছেন। আবার অনেক এলাকায় কেউ কোন কিছু দেয়নি। ফলে কিছু এলাকার মানুষের ভোগান্তি বেশি হয়েছে। সবাই যাতে সহায়তা পায় সেটি নিশ্চিত করতে এই প্রক্রিয়াটি সম্ভবত কার্যকর হবে। বিচ্ছিন্নভাবে সহায়তা না করে সমন্বিতভাবে করতে আপনার ‘সহায়তা সামগ্রী’ নিকটস্থ জনপ্রতিনিধি কার্যালয়ে দিয়ে আসতে পারেন।
মহামারীর এই মন্দ সময়ে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। আর বন্টন করতে হবে নিরাপদভাবে সব এলাকায়। আর মাথায় রাখতে হবে নিরাপদ দূরত্বের বিষয়টি। কেননা উপকার করতে গিয়ে যাতে ভাইরাস বিস্তারে সহায়ক না হয়ে যান।
মনে রাখতে হবে- বিপদ যতো বড়ই হোক, আল্লাহর রহমত সেটির চাইতেও বড়। আল্লাহ প্রতিটি মানুষকেই সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তাই নিজে পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন এবং সচেতন থেকে প্রমাণ করে দিন- মানুষই সৃষ্টির সেরা। সবাই নিরাপদে থাকুন, ভালো থাকুন।
লেখক :
মো. জামাল হোসেন
সম্পাদক
দৈনিক আনন্দবাজার