যে দেশে সমুদ্র রয়েছে সে দেশ কখনো অর্থনীতিতে গরীব থাকতে পারে না। পৃথিবীর খুব কমসংখ্যক অংশ হলো ভূমি। যেখানে অধিকাংশই সমুদ্র, সম্পদের বিশাল অংশ সেখানেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিকভাবে বঙ্গোপসাগরে রয়েছে সমুদ্র অর্থনীতির অপার সম্ভাবনা। তবে সেই সম্পদ অজর্নের আগেই তা নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে।
সমুদ্র অর্থনীতির অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সামুদ্রিক সম্পদকে সংরক্ষণ এবং দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। সমুদ্র দূষণ রুখতে পর্যটক, ব্যবসায়ী ও সমুদ্র সংশ্লিষ্টদের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তবে অসচেতনতা আর অজ্ঞতার কারণেই আমরা সমুদ্রের ক্ষতি করে যাচ্ছি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে প্লাস্টিকসহ অপচনশীল বস্তুর মাধ্যমে।
জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর ৫০ লাখ থেকে দেড় কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে প্রবেশ করছে। এর একটা বড় অংশ যাচ্ছে মাছ ও সামুদ্রিক পাখিদের দেহে। এমনকি সমুদ্রের তলদেশে থাকা প্রাণীদের শরীরেও প্লাস্টিকের সন্ধান মিলছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থার (আইইউসিএন) মতে, গাড়ির টায়ার ও বিভিন্ন টেক্সটাইল কারখানা থেকে নিঃসৃত ছোট ছোট প্লাস্টিকের বর্জ্য বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় সমুদ্র দূষণের মূল কারণ।
মোট দূষণের প্রায় ৩০ শতাংশই প্লাস্টিকের কারণে হয়ে থাকে। অথচ আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি তার অর্ধেকই উৎপাদন করে সমুদ্র, অর্থাৎ সমুদ্রের শৈবাল এবং ফিটোপ্লাঙ্কটন নামক এককোষী উদ্ভিদ। সাগর আমাদের আবহাওয়ামণ্ডল থেকে পঞ্চাশ গুণ বেশি হারে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাস করে থাকে।
সমুদ্রকে রক্ষার জন্য প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধ এবং অন্যান্য ক্ষতির বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। সমুদ্রের বৈচিত্র্য এবং উৎপাদনশীলতা সমগ্র মানবজাতির জন্য অপরিহার্য। মানুষের প্রয়োজনেই সাগরকে সুরক্ষা দিতে হবে। কলকারখানার বর্জ্য, জাহাজের বর্জ্য আর প্লাস্টিক সমুদ্রকে দূষণ করছে। বিশেষ করে সমুদ্রে বেড়াতে এসে প্রায় সব পর্যটক প্লাস্টিক ব্যবহার করছে। আর সে সব বর্জ্য সাগর পাড়ের যেখানে সেখানে ফেলছে। প্লাস্টিক উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া এ সমস্যা থেকে উত্তরনের পথ নেই।
কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিন গিয়ে দেখা যায়, পর্যটকের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বোতল এবং অন্যান্য সামগ্রীর স্তুপ এখানে সেখানে পড়ে রয়েছে। এতে যেমন সমুদ্র এবং পরিবেশের ক্ষতি করছে, তেমনি সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। স্থলভাগের পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে বহু আয়োজন, আন্দোলন, সভা-সেমিনার, কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়, অথচ সমুদ্রকে দূষণমুক্ত করতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। আমরা সবাই কোনো না কোনো ভাবে সমুদ্রের সাথে যুক্ত। বিশেষ করে দেশের ১৯টি জেলার লোক সরাসরি সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
এ সচেতনতা তৈরিতে শিগগিরই একটি সমুদ্র সাক্ষরতা অভিযান পরিচালনা জরুরি বলে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিওআরআই) মহাপরিচালক (ডিজি) সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার। তিনি বলেন, ‘একটি প্লাস্টিক বা পলিথিন প্রায় ৫০ বছর অপচনশীল থাকে। এসময় এগুলো সমুদ্রের পানি দূষণ ও প্রাণীর ক্ষতি করে। এক সময় এসব প্লাস্টিক ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরায় পরিণত হয়। এগুলো পানির সঙ্গে মাছের পেটে ও কানকোয়ায় প্রবেশ করে। এভাবে প্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে। একইসঙ্গে এসব প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র টুকরা ফাইটোপ্লাঙ্কটন, সিওইড, কোরালসহ অন্যান্য সামুদ্রিক স্পেসিস ও প্রাণের জীবনধারণে বাধা সৃষ্টি করে। তাই পর্যটক, ব্যবসায়ী ও সমুদ্র সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতনতা ক্যাম্পেইনের আওতায় এনে একটি সমুদ্র সাক্ষরতা অভিযান পরিচালনা জরুরি।
সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার আরো বলেন, ‘আমরা অক্সিজেনের জন্য গাছ লাগাই কিন্তু আমরা জানি না সামুদ্রিক শৈবাল ফাইটোপ্লাংকটন ৭০ শতাংশের বেশি (৭০-৭৬ শতাংশ) অক্সিজেন সরবরাহ করে। একই সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে।
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ আওয়ার সি’ এর মহাসচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, ‘কলকারখানার বর্জ্য নদী হয়ে সাগরে এসে দূষণ করে, সাগরে চলাচলকৃত জাহাজের পোড়া তেল আর বর্জ্যরে সমুদ্র দূষণ হয়। প্লাস্টিক সমুদ্রকে সবচেয়ে বেশি দূষণ করছে। সমুদ্রের দূষণ রোধে যেমন ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনি এর সম্পদ আহরণেও বিশেষ উদ্যোগী হতে হবে।
আনন্দবাজার/শহক