সাগরের হাঙ্গর শিকার পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে নিষিদ্ধ হলেও মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইনে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনাই নেই। আর এটাই হয়েছে কাল। আইনের এই ফাঁক গলে বঙ্গোপসাগর থেকে অবাধে শিকার করা হচ্ছে লাখ লাখ হাঙ্গর। জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি হলেও হাঙ্গরের বাচ্চা ধরে শুঁটকি বানিয়ে দেশের নানা অঞ্চলে বিক্রির পাশাপাশি রপ্তানি করা হচ্ছে বিদেশেও। এতে সাগরের জীববৈচিত্র যেমন হুমকিতে পড়েছে, তেমনি পরিবেশেরও বিপর্যয় ঘটছে।
স্থানীয় সূত্রমতে, উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের পাশাপাশি বিদেশে হাঙ্গরের শুঁটকির চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে। শুঁটকি ব্যবসায়ীরা তাই হাঙ্গর শিকার ও শুঁটকি তৈরির খাতে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে হাঙ্গর শিকার বঙ্গোপসাগরের ফুড চেইন নষ্ট করে দিচ্ছে। যা জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি।
দীর্ঘদিন ধরেই বঙ্গোপসাগরের বিস্তৃত জলরাশির বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখ লাখ হাঙ্গরের বাচ্চা শিকার করা হচ্ছে। এসব হাঙ্গর কেটে রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হচ্ছে শুঁটকি। শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা, পটিয়া, কর্ণফুলি ও বাঁশখালি এলাকাতেই শতাধিক শুঁটটি পল্লিতেই অবাধে তৈরী হচ্ছে হচ্ছে হাঙ্গরের শুটকি। উপকূলীয় এলাকায় শুটকি তৈরি করে তা দেশের পার্বত্যাঞ্চলসহ বিভিন্ন বাজারে অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে। রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। হাঙ্গর এক প্রজাতির মাছ হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ তা খায় না। জীববৈচিত্র সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে হাঙ্গর শিকার নিষিদ্ধ।
বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনেও হাঙ্গর ও ডলফিন শিকার নিষিদ্ধ। অথচ মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইনে হাঙ্গর নিয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। বিভিন্ন সময় মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইনে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও হাঙ্গর শিকারের ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে হাঙ্গর শিকার নিষিদ্ধ হলেও বঙ্গোপসাগরে অবাধে হাঙ্গর শিকার নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। এতে করে হাঙ্গর শিকারের কার্যক্রম অবাধে চলছে সাগরে।
গবেষকদের হিসাবে, দেশে হাঙ্গর এবং হাউস (শাপলাপাতা মাছ) মিলিয়ে প্রায় ২৭টি প্রজাতি রয়েছে। এসব প্রজাতির মধ্যে ইয়েলো ডগ শার্ক (টুইট্যা হাঙ্গর), মিল্ক শার্ক (কামোট হাঙ্গর), হ্যামারহেড হাঙ্গর (হাতুড়ী হাঙ্গর), বুল শার্ক (বলি হাঙ্গর)। বিগত ২০০৮-২০০৯ সালে দেশে প্রায় চার হাজার টন হাঙ্গর ধরা হয়েছিল। ব্যাপকভাবে শিকারের কারণে দেশে বড় আকারের হাঙ্গর প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
সূত্রমতে, বিভিন্ন জাহাজ আর মাছ ধরার ট্রলারগুলো সাগরে হাঙ্গর শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পরিণত বয়সে হাঙ্গর অনেক বড় হয়। বড় হাঙ্গর শিকার কঠিন। তবে অপেক্ষাকৃত ছোট হাঙ্গর ঝাঁকে ঝাঁকে জালে আটকা পড়ে। এসব বাচ্চা বা শিশু হাঙ্গর শিকারের পর কেটে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি পল্লীতে তৈরি করা হয় হাঙ্গর শুটকি। জাহাজ থেকে নামানোর পর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে শুঁটকি তৈরির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরে এসব শুঁটকি চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আড়তে বিক্রি করা হয়। পার্বত্য অঞ্চলের পাশাপাশি বিশেষ করে উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে বিক্রি হয় হাঙ্গরের শুঁটকি।
তবে হাঙ্গরের শুঁটকির চাহিদ শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠী কিংবা দেশের বিভিন্ন এলাকাতেই নয়, বিদেশেও চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে চীন, কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ডসহ নানা দেশে চাহিদা থাকায় এসব দেশে হাঙ্গরের শুঁটকি রপ্তানি করা হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, এছাড়া হাঙ্গরের মাংস, পাখনা, চামড়া এবং হাড়ের বিশ্বব্যাপী চাহিদা রয়েছে। পাখনা দিয়ে তৈরি সুপ হংকং, তাইওয়ান ও চীনের অভিজাত হোটেলে বেশ জনপ্রিয়। হাঙ্গরের পাখনায় মার্কারি নামক উপাদান থাকায় এসব দেশে নব দম্পতিকে হাঙ্গরের সুপ খাওয়ানো হয়। হাঙ্গরের লিভার ও নাড়িভুঁড়ি থেকে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ তৈল সংগ্রহ করে তা পোল্ট্রি শিল্পে, রং কারখানায়, বার্নিশ ও কসমেটিক্স ও ঔষধ শিল্পে, ট্যানারিতে চামড়া নরম করতে ব্যবহৃত হয়। কামোট, বলি হাঙ্গর এর চামড়া দিয়ে দামি শিরিষ কাগজ তৈরি করা হয়। হাঙ্গরের পিঠের চামড়া বাদ্যযন্ত্র ও বিদেশে হ্যান্ডব্যাগ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। হাড় কসমেটিক্স ও শোপিজ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গোপসাগর থেকে অবাধে হাঙ্গর শিকার সাগরের জীববৈচিত্রের জন্য বড় হুমকি। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, আইনে বিশেষ কোনো নির্দেশনা না থাকায় হাঙ্গর শিকার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় জেলেদের হাঙ্গর শিকার না করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। আমরাও জেলেদের নানাভাবে বুঝিয়ে থাকি। তবে তারপরও হাঙ্গর শিকার বন্ধ হচ্ছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা দৈনিক আনন্দবাজাকে বলেন, আইনে হাঙ্গর শিকার নিষিদ্ধ হলেও হাঙ্গর শিকারের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়নি। বিষয়টি মৎস্য অধিদপ্তর দেখভাল করে। সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তর কখনো কোনো অভিযান পরিচালনা করেনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, হাঙ্গর বঙ্গোপসাগরের ইকো সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অপরিকল্পিতভাবে হাঙ্গর শিকার বঙ্গোপসাগরের ফুড চেইন নষ্ট করে দিচ্ছে। যা জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি।
আনন্দবাজার/শহক