ঢাকা | শুক্রবার
২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাটিতেই মিশে গেল ইট

মাটিতেই মিশে গেল ইট

মাঘের শীতে বর্ষণ

বৃষ্টির পানিতে মিলিয়ে যায় ইটভাটা মালিকদের স্বপ্ন

রংপুরে ২০০ ইটভাটার ক্ষতি ১৫০ কোটি টাকা

হাটুপানি জমে থাকায় অনেক ভাটা সাময়িক বন্ধ

কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার

ক্ষতি পূষিয়ে নিতে ইটের দাম বাড়ানো হবে

সবেমাত্র শুরু হয়েছে ইটভাটায় ইট পোড়ানোর মৌসুম। চাহিদা অনুযায়ী ইট তৈরিতে ভাটাগুলোতে চলছিল কর্মযজ্ঞ। থরে থরে সাজানো ছিল পোড়ানোর অপেক্ষায় মাটির তৈরি কাঁচা ইট। রোদে শুকানোর পর পর্যায়ক্রমে যা পোড়ানোর কথা। কিন্তু পুড়িয়ে লাল করার আগেই মাটির তৈরি কাঁচা ইট মাটিতেই মিশে গেছে। মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহে গত শুক্রবার ও শনিবার হঠাৎ অবিরাম বর্ষণে সাজানো কাঁচা ইট ভিজে-গলে একাকার হয়ে যায়, বৃষ্টির পানিতে মিলিয়ে যায় ভাটা মালিকদের স্বপ্ন। রংপুর আবহাওয়া অফিস জানায়, মাঘ মাসে এ ধরণের অবিরাম বৃষ্টিপাতের ঘটনা বিরল। দু’দিনে রংপুরে ৬৪ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

ইটভাটা মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, উত্তরের রংপুর জেলায় ২০০টির মত ইটভাটা রয়েছে। মৌসুম শুরু হওয়ায় প্রত্যেক ভাটায় ইট তৈরির কাজ চলছিল। ভাটাগুলোতে পোড়ানোর অপেক্ষায় সারি করে সাজানো ছিল লাখ লাখ কাঁচা ইট। কিন্তু অসময়ে আকষ্মিক দু’দিনের বৃষ্টিতে সেসব ইট ভিজে-গলে নষ্ট হয়ে যায়। এতে ভাটা মালিকদের প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি তাদের। 

সরেজমিনে রংপুরের বিভিন্ন ইটভাটা ঘুরে দেখা যায়, দু’দিনের ভারি বর্ষণে মাটির তৈরি কাঁচা ইটগুলো ভিজে-গলে মাটিতেই মিশে গেছে। রোদে শুকিয়ে পোড়ানোর অপেক্ষায় ইটখোলায় প্রস্তুত করে রাখা ইটের  পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক ইটভাটায় এখনো হাটুপানি জমে থাকায় নতুন করে ইট তৈরি করার সুযোগ নেই। সাময়িকভাবে এসব ইটভাটার কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কর্মরত কয়েক হাজার শ্রমিক।

বদরগঞ্জ উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান হোসেন জানান, এখানে ইটভাটার সংখ্যা ৬৫টি। এমনিতে এবছর কয়লার দাম আগের বছরের থেকে প্রায় আড়াইগুন বেশি হওয়ায় ইট পোড়াতে গিয়ে লোকসানে পড়েছেন ভাটা মালিকরা। সে কারণে অনেক মালিক ইট পোড়ানোর কাজও  দেরিতে শুরু করেছেন। তার ওপর অসময়ের বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট ক্ষতিতে মূলধন খোয়ানোর শঙ্কায় রয়েছেন তারা। অনেক ইটভাটার চুলার উপরের ইটগুলোও বৃষ্টিতে গলে গেছে। এই ক্ষতি অপূরণীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিগত বছরগুলোরা লাভ দিয়েও এবারের ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব নয়।’ মিঠাপুকুরের রাণীপুকুর এলাকার এইচবি ইটভাটার মালিক প্রবীণ ব্যবসায়ী রশীদ সরকার বলেন, ‘আমার দীর্ঘ ব্যবসা জীবনে ইট ব্যবসায় এমন ক্ষতি কখনো দেখিনি। কয়লার দাম বেশি হওয়ার কারণে এবছর ইটের দামও বেশি। ফলে বিক্রি আগের তুলনায় কমে গেছে। অন্যদিকে আশার আলোটুকুও নিভিয়ে দিল মাঘের বৃষ্টি।’   

পীরগঞ্জে ৫৮টি ইটভাটায় ইট পোড়ানো হচ্ছে। কাঁচা ইট গলে যাওয়ায় সবগুলো ভাটা মালিকই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কানঞ্চগাড়ী এলাকার ভাটা মালিক উজ্জ্বল মিয়া জানান, তার প্রায় ১০ লাখ কাঁচা ইট পানিতে ভিজে গলে গেছে। দুটি ইটভাটায় তার প্রায় এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।  পীরগঞ্জেই ভাটা মালিকদের প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম রবি। পীরগাছার সাতদরগাহ বাজারের মেসার্স শিল্পী এন্টারপ্রাইজ নামের ভাটার মালিক মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ভাটার প্রায় আট লাখ কাঁচা ইট নষ্ট হয়েছে। আশপাশের ভাটার প্রায় ১৪ লাখ কাঁচা ইট ভিজে-গলে মাটি হয়ে গেছে। এই মাটিগুলো সরিয়ে আবার রিসাইকেল করতে (নতুন করে তৈরি করা) অনেক সময়ের প্রয়োজন। ইটের চাহিদা দিয়ে অনেকেই আগাম টাকা দিয়েছিলেন, তাদের ইট এখনও ডেলিভারী দেওয়া হয়নি। পীরগাছা উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি রনজু হাজী জানান, এখানে ৫০টি ইটভাটা রয়েছে। অসময়ের বৃষ্টির পানিতে ইট নষ্ট হওয়ায় ভাটা মালিকদের বিশাল অঙ্কের টাকার ক্ষতি হয়েছে। তারপরও অনেকেরই নতুন করে ইট তৈরিসহ পোড়ানোর কাজ শুরু করতে হবে। ফলে পুঁজি হারিয়ে পথে বসতে হবে তাদের।

বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি রংপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক বলেন, কয়লার দাম বাড়ায় এবছর এমনিতে ইটের দামও বেড়েছে। বৃষ্টির কারণে ক্ষতি পূষিয়ে নিতে ক্লোজডাউন ছাড়া (বিরুপ পরিস্থিতিতে দাম বাড়ানো) উপায় নেই। ইতোমধ্যেই রংপুরে ইটের দাম হাজার প্রতি ১০ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই দাম ১৫ হাজারেও যেতে পারে বলে ভাবছেন অনেক ব্যবসায়ী। তিনি জানান, অসময়ের অবিরাম বর্ষণে নজিরবিহীন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন ইটভাটা মালিকরা। রংপুর জেলায় প্রায় ২০০টি ইটভাটা আছে। প্রত্যেক ভাটায় গড়ে ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আবার রিসাইকেল করে ইট তৈরি করতে এর থেকে বেশি খরচ পড়বে। রিসাইকেল করা পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন