ঢাকা | রবিবার
২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর

অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর
  • অনেক অ্যাম্বাসিতে ব্যবসায়ী উইং নেই
  • সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগানো হচ্ছে না
  • বিশ্ববাজারে দাবি আদায় করতে পারছি না
  • কর্পোরেট কর হার আঞ্চলিক দেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করা প্রয়োজ

ভিয়েতনামের গ্রোস ডমেস্ট্রিক প্রোডাক্ট-জিডিপিতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৩২ ও ভারতের ২২ শতাংশ হলেও আমাদের মাত্র ১ শতাংশ। এ হার বাড়াতে হলে সরকারের কার্যকরি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি- ডিসিসিআই’র সভাপতি রিজওয়ান রাহমান।

তিনি বলেন, সরকার দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন করছে। শুধু এই জোন করলেই তো হবে না, বিদেশিদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা যারাই বিনিয়োগ করতে আসে তারা তো অনেক ধরনের শর্ত দিয়ে থাকে। স্থানীয় বাজার ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানির বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে থাকে। এসব অর্থনৈতিক জোনে যদি বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগসহ অন্যান্য সুবিধা যথাযথভাবে না থাকে তবে হবে না। তা ছাড়া থাকতে হবে যাতায়াতের সুবিধাও।

গতকাল রবিবার দুপুর ১২টায় ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে মিট দ্যা প্রেসে তিনি এসব কথা বলেন। আরো উপস্থিত ছিলেন সহ-সভাপতি আরমান হক এবং সহ-সভাপতি মনোয়ার হোসেন।

রিজওয়ান রাহমান সমসাময়িক অর্থনীতি বিষয়ক ১০টি বিষয়বস্তুর উপর বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরার, পাশাপাশি ২০২২ সালে ডিসিসিআই’র কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। তিনি এ বছর ঢাকা চেম্বার সিএমএসএমই, বেসরকারি বিনিয়োগ ও এফডিআই, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, সমুদ্র অর্থনীতি, দক্ষতা উন্নয়ন, ডিজিটাল এনগেইজমেন্ট, কর ব্যবস্থাপনা এবং এলডিসি উত্তোরণ প্রভৃতি বিষয় সমূহের উপর অধিক হারে গুরুত্বারোপ করেন।

রিজওয়ান রাহমান বিশ^ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ২০২১ সালে দেশে এফডিআই এসেছে ২.৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৫ সালে ছিল ২.২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে আসে ২৫৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২১ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে এসেছিল ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার।

বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশেও বিনিয়োগ করবে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবে হতাশার কথা হচ্ছে আমাদের অনেক এম্বাসিতে ব্যবসায়ী উইং নেই। এ ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ আমাদের দেশ সম্পর্কে কিভাবে জানবে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিসগুলোতে আরো সচল করতে হবে, বলেন সভাপতি।

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বিশেষ করে বিদ্যমান করকাঠামোর প্রতিবন্ধকতা নিরসন ও যুগোপযোগীকরণ, ক্রস-বর্ডার বাণিজ্য সম্প্রসারণে নীতি সহায়তা প্রদানের উপর জোরারোপ করেন রিজওয়ান। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল ডিজিপি’র ২১.২৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এডিআই’র পরিমাণ ছিল ২.৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এমতাবস্থায় বেসরকারি বিনিয়োগ এবং এফডিআই বৃদ্ধিতে কর্পোরেট কর কাঠামোর সংস্কার, দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহে সকল ধরনের সেবাপ্রদান নিশ্চিতকরণ একান্ত অপরিহার্য।
তিনি বলেন, বর্তমানে কয়েকটি দেশে আমাদের রপ্তানি সীমাবদ্ধ। তার মধ্যে কানাডাতে ৩ শতাংশ, জাপানে শতাংশ ৩.০৫, নেদারল্যান্ডে ৩.৩০, ফ্রান্সে ৫.০৬, যুক্তরাজ্যে ৯.৬৮, যুক্তরাষ্ট্রে ১৭.৯৯ ও জার্মানিতে ১৫.৩৬ শতাংশ। সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ২২ শতাংশ, ইউরোপে ৪৫, ওআইসিভুক্ত দেশে ৫, মধ্যপ্রাচ্যে ৩, আফ্রিকায় ১, এশিয়ায় ১৬ ও অন্যান্য মিলে ৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে নতুন বাজার খোঁজতে হবে।

রিজওয়ান রাহমান বলেন, এলডিসি উত্তোরণের পর বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বেশ প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি পিটিএ এবং এফটিএ স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নেগোশিয়েশনের দক্ষতা আরো বাড়ানো অতীব জরুরি, সেই সাথে এফটিএ’র উপর আমাদের অধিক হারে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।

কেননা আমরা বিশ^বাজারে নিজেদের দাবিগুলো আদায় করতে পারছি না। কারণ সব দেশেই অর্থনীতিবিদ ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গ্রুপ তৈরি করে আলোচনা করে থাকে। তাদের প্রশ্নের জবাব যথাযথভাবে দিতে না পারলে বিনিয়োগ করে না। আমাদের দেশে এই কার্যক্রম এখনো চালু হয়নি। অল্প কয়েকজন ব্যবসায়ী হয়তো সরকারের সঙ্গে সফরে যায় তারা বেশির ভাগই সঠিক জবাব দিতে পারে না। কোন মতে বেঁচে আসার পথ খোঁজে ফলে অনেক চুক্তিতে আমরা আশানুরুপ ফল পাই না। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী,অর্থনীতিবিদ, আইনজীবীসহ সকলের সমন্বয়ে প্রতিনিধি দল তৈরি করা দরকার।

সভাপতি বলেন, একমাত্র অটোমেশনই পারে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য খাতে সকল প্রকার দুর্নীতিরোধ পূর্বক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কর্পোরেট করের বিষয়ে তিনি বলেন, এলডিসি উত্তোরণের পূর্বে বাংলাদেশের কর্পোরেট কর হার আঞ্চলিক দেশসমূহের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করা প্রয়োজন এবং এলক্ষ্যে তিনি বিদ্যমান কর্পোরেট কর ২০২২-২৩ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যথাক্রমে ৫% ও ৭.৫% হারে ক্রমান্বয়ে হ্রাস করতে হবে।
তিনি বলেন, এলডিসি উত্তোরণের পর আমাদের রপ্তানিমুখী পণ্যের উপর শুল্ক হার বর্তমানের চেয়ে ৬-৭% বৃদ্ধি পেতে পারে, ফলে এখন থেকে আমাদের পণ্যের বহুমুখীকরনের সাথে সাথে বাজার সম্প্রসারণের উপর মনোযোগী হতে হবে। এছাড়া রপ্তানি বৃদ্ধিতে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারের প্রতি আমাদের আরো মনোযোগী হওয়ার প্রস্তাব করেন।

তিনি বলেন, জিডিপিতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেসরকারিখাতের অবদান ছিল ২৩.১ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৩.৫৪ শতাংশ ও ২১.২৫ শতাংশ। এই যে, বেসরকারিখাত উন্নতি করছে এ জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে নীতিগুলো তৈরি করা দরকার। আমরা টেক্স কমানোর কথা বললেও রেভিনিউ বাড়ানোর কথা বলছি না। ব্যবসায়ীদের এ পথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

রিজওয়ান রাহমান বলেন, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ জামানত পদ্ধতি বাদ দিয়ে আরো আধুনিক করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বৃহৎশিল্প, মাঝারি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সবাইকে ভাগ করে ঋণ দেয়ার পদ্ধতি নেয়া দরকার। শুধুই বড়রা ঋণ নিয়ে গেলে অন্যান্যরা ঋণ পায় না। আর বড়দের অনেকেই আবার ঋণ পরিশোধ করে না। এতে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে। আমরা এই পদ্ধতির পরিবর্তন প্রত্যাশা করি।

তিনি স্মল মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ-এসএমইখাতের ক্ষেত্রে সরকারকে একটি জোন করার বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন, প্রয়োজনে একটি জোন করা যেতে পারে। যাতে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখতে পারে কোন ব্যাংক কত টাকা এখাতে ঋণ দিলো।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, কোভিড মহামারী কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশেষ করে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়টি আরো সহজীকরণ করা প্রয়োজন। বৈশি^ক প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার জন্য আমাদের মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে কোন বিকল্প নেই। বলেন, এ ব্যাপারে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে আরো বেশি হারে বিনিয়োগে এগিয়ে আসার উপর জোরারোপ করতে হবে।

মোবাইল ফাইনান্সিং সিস্টেম (এফএমই)কে আরো সহজ করতে হবে। কেননা বিশ^ এখন খুব এগিয়ে গেছে। আমরা সে পথ না ধরলে পিছিয়ে পড়বো বলে উল্লেখ করেন তিনি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে ৫৫ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। তাদেরকে যুগোপযোগী না করতে পারলে আমরা পিছিয়ে পড়বো বলে জানান ডিসিসিআই সভাপতি।
সমুদ্র অর্থনীতিকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হিসেবে উল্লেখ করে তিনি জানান, এ সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য একটি কার্যকর রূপকল্প প্রণয়ন করা দরকার।

কেননা ভারত-মিয়ানমার আমাদের সমুদ্র থেকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। সমুদ্র সম্পদ নিয়ে যায় এসব আমরা কেন রুখতে পারছি না। এখনই যদি সচেতন না হই তবে পস্তাতে হবে। আমরা সমুদ্রকে জোন জোন ভাগ করে বিনিয়োগ করতে পারি বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ছোট্ট দেশ মালদ্বীপের সমুদ্র অর্থনীতিতে আয় ৩.১ শতাংশ, মিয়ানমার, ভারত, শ্রীলঙ্কা অনেক এগিয়ে অথচ আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তি নেই। উন্নয়নের বিষয়ে চিন্তার অভাব রয়েছে। সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগানো হচ্ছে না বলেন রিজওয়ান।

তিনি নৌপথের গুরুত্ব উল্লেখ করে বলেন, আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যে পানিপথ ব্যবহার করতে পারি এমন ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কেননা সেখানে ট্রাফিক জ্যাম নেই। খরচ কম। সুবিধা বেশি। তাতে করে অনেক সময় ও অর্থ বেঁচে যাবে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, কোভিড মহামারী থাকা সত্ত্বেও ২০২১ সালে আমাদের বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৪৩ শতাংশ এবং পণ্য রপ্তানি, রেমিট্যান্স এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে বেশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন