ঢাকা | শনিবার
১২ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২৭শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রানওয়ে এখন গোচারণভূমি

রানওয়ে এখন গোচারণভূমি

দেশের উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত বিমানবন্দর এখন গো-চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। পরিত্যক্ত বন্দরের কিছু জমিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে। রানওয়ে ব্যবহার হচ্ছে ফসল শুকানোর কাজে। গত ২০১৬ সালে বিমানবন্দরটির অবকাঠামো পরিদর্শন করে তিন মাসের মধ্যে কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস দিয়েছিলেন বর্তমান সরকারের তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তবে গত অর্ধযুগেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে রিজিওনাল হাবে পরিণত করার কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালে। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর আগমনে বিমানবন্দর চালুর স্বপ্ন দেখেন ঠাকুরগাঁওবাসী। তবে আজও তা আলোর মুখ দেখেনি। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর ও পঞ্চগড়ে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন চালু হলে উত্তরাঞ্চলে উন্নয়নের গতি বাড়বে।

সূত্রমতে, ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ আমলে ঠাকুরগাঁও জেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ঠাকুরগাঁও-পীরগঞ্জ সড়কের পাশে শিবগঞ্জ এলাকায় ৫৫০ একর জমির ওপর বিমানবন্দর নির্মিত হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় ভারতীয় বিমানবাহিনী হামলা চালালে বিমানবন্দরের রানওয়েটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৭ সালে বিমানবন্দরটির সংস্কার করা হয়।

এরপর কয়েক বছর ধরে এখানে বাণিজ্যিক ফ্লাইটও পরিচালিত হয়। তবে আগ্রহের অভাব আর যাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ায় বিমানবন্দরের কার্যক্রম থমকে যায়। এক পর্যায়ে ১৯৮০ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে বিমানবন্দরের অনেক জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে। রানওয়েটি পরিণত হয়েছে গো-চরণভূমিতে। ব্যবহার হচ্ছে ফসল মাড়াই আর ফসল শুকানোর চাতাল হিসেবে।

বিমানবন্দরটির রানওয়ের দৈর্ঘ্য ছয় হাজার ফুট আর প্রস্থ ৬০০ ফুট। একটি টার্মিনাল ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে বিমানবন্দরের দেড়শ একর জমিতে সরকারিভাবে অথবা লিজ দিয়ে চাষাবাদ করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকার পর বিমানবন্দরটি সচল করার লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে সংস্কার করা হয়। এরপরই জেলাবাসী স্বপ্ন দেখতে থাকে বিমানবন্দরটিতে আবারো বিমান উড়বে।

গত চার দশক ধরে বিমানবন্দরটি পরিত্যক্ত থাকায় ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারছে না জেলার মানুষ। তারা মনে করছেন, রানওয়েতে আটকে আছে সমৃদ্ধ ঠাকুরগাঁওয়ের আর্থিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। বিমানবন্দরটি চালু করা অত্যন্ত জরুরি দাবি করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে জেলার শিল্পকারখানায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের আশ্বাসে আশাবাদী হয়েছিলেন ঠাকুরগাঁওবাসী। তবে গত অর্ধযুগে বিমানবন্দরটি চালুর ব্যাপারে একধাপও অগ্রসর হয়নি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণায়লয়। এমন মন্তব্য ঠাকুরগাঁওয়ের সমাজকর্মী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মাহাবুব আলম রুবেল।
রুবেল বলেন, সরকার ঠাকুরগাঁওকে একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল বললেও বিমানবন্দরটি চালু হচ্ছে না। অথচ এখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে বিমানবন্দর সচল করার বিষয়টি জড়িত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আলী নোমান আব্দুল্লাহ্ বলেন, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলায় অনেক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন রয়েছে। দেশে-বিদেশের অনেক দর্শনার্থী যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় যেতে চান না। বিমানবন্দরটি চালু হলে অনেক পর্যটক, দর্শনার্থী ঠাকুরগাঁওয়ের এসব দর্শনীয় স্থানে খুব কম সময়ে আসতে পারবেন।

জেলার একটি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক মাহমুদ হাসান প্রিন্স বলেন, বিমানবন্দরটি চালু হলে এ অঞ্চলে শিল্পের বিপ্লব ঘটবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে এ অঞ্চলের প্রত্যেকটি পেশার মানুষ আর্থিক সুফল ভোগ করবে।

অর্থনীতির বিশ্লেষক মতিউর মিঠু বলেন, বিমানবন্দরটি চালু করতে সর্বোচ্চ ১শ কোটি টাকা লাগবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এ বাজেট থেকে মাত্র ১০০ কোটি টাকা একটি জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিদিন গড়ে ১০০-১২০ জন যাত্রী দুইটি ফ্লাইটে যাতায়াত করলে সরকার এটিকে লাভজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবে। ধীরে ধীরে যাত্রী আরও বৃদ্ধি হবে। বিমানবন্দরটি চালু হলে নেপাল ও ভূটানের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত হবে। অঞ্চলটি অর্থনৈতিক ভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সফলতা লাভ করবে।

ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেতা মুহা. সাদেক কুরাইশী বলেন, বিমানবন্দরটি চালু করার দাবিতে ঠাকুরগাঁওবাসীর সঙ্গে পুরোপুরি একমত। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন সভা সমাবেশে এ অঞ্চলের মানুষের সুবিধার জন্য, ভোগান্তি লাঘবের জন্য বিমানবন্দর চালু, ঠাকুরগাঁও রোড এলাকায় একটি রেলওয়ে হাসপাতাল, রেলওয়ে নিরাপত্তা চৌকি স্থাপনসহ বিভিন্ন দাবিবক্তব্যের মাধ্যমে উপস্থাপনও করেছি।

ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর একটি ঐতিহ্যবাহী পুরোনো বিমানবন্দর। এটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে চালুর বিষয়ে ঠাকুরগাঁওবাসীর দাবি রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন