ধীর গতিতে চলনবিলের মধ্য দিয়ে ভাটির দিকে প্রবাহিত হতো পানি। কথিত আছে এ কারণেই এ বিলের নামকরণ করা হয় চলনবিল। বাংলাদেশের বৃহৎবিল এটি। তবে বর্তমানে বিলটি মরাবিলে পরিণত হয়েছে। এ এলাকার নদ-নদী খাল বিলগুলো নব্যতা সংকটে ভূগছে। এতে সেচকাজ ব্যহত হওয়ার পাশাপাশি দেশিও মৎস্যসম্পদ বিলুপ্তির পথে। এর প্রভাব পড়ছে ব্যবসা বাণিজ্যেও। দীর্ঘদিন ধরে খনন কাজ না করায় চলনবিল এলাকার খাল-বিল, নদী-নালা হারাচ্ছে নিজস্ব স্বকীয়তা।
বোরো মৌসুমের আগে বাড়তি ফসল পাওয়ার জন্য অনেকে জমিতে ছিটিয়েছিলেন সরিষা বীজ। এখন সরিষা উত্তোলন করে বোরো ধানের চারা রোপণ করছেন চাষিরা। বিলের সঙ্গে নদ-নদীর সংযোগ খালগুলো শুকিয়ে গেছে প্রায় মাস দুয়েক আগে। চলতিমৌসুমে ফালগুনের শুরুতেই অধিকাংশ নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে চলনবিল এলাকার প্রায় সকল নৌরুট। নদী, খাল-বিলে পানি না থাকায় এ এলাকার হাট বাজারে দেশি মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। জল পথে পণ্য পরিবহনে খরচ কম হলেও বর্তমান সময়ে এ এলাকার প্রায় সব জলপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অধিক খরচে ব্যবসায়ীদের স্থল পথে পণ্য পরিবহণ করতে হচ্ছে।
অধ্যক্ষ মো. আব্দুল হামিদ রচিত চলনবিলের ইতিকথা গ্রন্থ থেকে জানা যায়, জলপাইগুড়ির পাহাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া আত্রাই ও গুর নদী রাজশাহীতে এসে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়। এর একটি শাখা কয়রাবাড়ি, নন্দনালী, ও আত্রাই হয়ে আত্রাই ঘাটের এক মাইল নিন্ম হতে ‘গুড়’ নামে সিংড়া, একান্ন বিঘা, যোগেন্দ্রনগর ও কালাকান্দরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁচকৈড় ত্রীমোহনায় নন্দ কুজার সঙ্গে মিশেছে। এদের মিলিত স্রোতস্বীনি গুমানী নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে বড়াল নদীর সঙ্গে মিশেছে।
১৭৮৭ সালে তিস্তার সঙ্গে আত্রাই নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জলপাইগুড়ির উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ নিমগাছী তাড়াশ, চাটমোহরের হান্ডিয়াল হয়ে অষ্টমনিষার কাছে বড়াল নদীতে মিশেছে। ১৩০৪ সালে ভূমিকম্পে নদীটির কয়েক যায়গা মরে যায়। করতোয়ার নিম্নাংশ আত্রাই ও ফুলঝোড় নামে পরিচিত। বড়াল নদী পদ্মার চারঘাট মোহনা থেকে নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম হয়ে চাটমোহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে গুমানীর সঙ্গে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া ফরিদপুর বাঘাবাড়ি হয়ে হুরাসাগরের সঙ্গে মিশে নাকালিয়া এলাকায় গিয়ে যমুনার সঙ্গে মিশেছে।
চেঁচুয়া নদী ধারাবারিষার দক্ষিণপাশ দিয়ে চতরার বিল, জোড়দহ, আফরার বিল, খলিশাগাড়ি বিল ও কিনু সরকারের ধর হয়ে চরসেনগ্রামের পশ্চিমে গুমানী নদীর সঙ্গে মিশেছে। এ নদীটি ও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।
দক্ষিণ চলনবিলের বড়াইগ্রামের চিনাডাঙ্গা বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাবনার চাটমোহরের মূলগ্রাম ফৈলজানা হয়ে ফরিদপুরের ডেমরার কাছে চিকনাই নদী বড়াল নদীতে মিশেছে। ডেমরা এলাকায় স্লইজগেট থাকায় ফরিদপুর থেকে নদীটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্ষামৌসুমে মাস চারেক এ নদীতে পানি থাকলেও বাকি ৮ মাস পানি শূণ্য থাকে নদীটি। এগুলো ছাড়াও বানগঙ্গা, তুলশী নদী, ভাদাই নদী, মরা আত্রাই নদীর অবস্থা অত্যন্ত করুণ।
এ নদীগুলো ছাড়াও নবীর হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনুসরকারের ধর, পানাউল্লাহ খাল, নিমাইচড়া-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, কিশোরখালী খাল, বেহুলার খাড়ি, বাঁকাইখাড়ি, গাড়াবাড়ি-ছারুখালী খাল, জনিগাছার জোলা, খলিশাগাড়ি বিল, ধলাইর বিল, ছয়আনির বিল, বাঁইরার বিল, সাধুগাড়ী বিল, মহিষা হালটসহ চলনবিলাঞ্চলের অন্যান্য নদী, শাখানদী, খাল, বিল, খাড়ি এখন একেবারে শুকিয়ে গেছে।
নদী খাল বিল খাড়ি শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা যমুন নদী হয়ে ঢাকা থেকে যে সকল পণ্য নৌপথে আনতেন এখন তা পারছেন না। সড়কপথে পণ্য পরিবহনে তাদের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। ক্রেতারা ও বিভিন্ন হাটবাজার থেকে পণ্য কিনে নৌপথে বাড়িতে নিতে পারছেন না। জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মৎস্যজীবি। পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন তারা। পূর্বে নদী থেকে কৃষক অগভীর নলকূপের সাহায্যে বোরো ক্ষেতে পানি সেচ দিতে পারলেও এখন তা পারছেন না।
উপরন্ত পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় অগভীর পাম্প মালিকরা মৌসুমের শুরুতেই তাদের সেচ পাম্প সমতল থেকে অন্তত ১০ ফিট নিচে স্থাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। আত্রাই রিভার ড্রেজিং কাজ শুরু হলেও সেখানে অনিয়মের প্রশ্ন ওঠে শুরু থেকে।
চাটমোহর সরকারি কলেজের ভূগোল বিষয়ের বিভাগের বিভাগীয় প্রধান পরিবেশ বিদ ড. এসএম মুক্তিমাহমুদ জানান, ভৌগলিকভাবে এ এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো নদীর জীবনচক্রের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ বার্ধক্য অবস্থায় পরিণত হয়েছে। লক্ষণীয় যে, চলনবিল এলাকার নদীর তলদেশের ঢালের পরিমান কম, নদীর প্রবাহমান পানির পরিমান কম, স্রোতের বেগও কম। উৎসস্থান থেকে নদীগুলোর দূরত্ব অধিক হওয়ায়, পানির সঙ্গে প্রবাহিত মৃত্তিকাকনা বালুকনা, নুড়িকনা এবং অন্যান্য ময়লা আবর্জনার পরিমান বেশি ও নদীর তলদেশে তা সঞ্চয়নের পরিমান ও অধিক হওয়ায় ক্রমশই নদী উপত্যকার পানি ধারণ ক্ষমতা কমে আসছে।
এতে বন্যার সময় ব্যাপক বন্যা এবং শুষ্ক মৌসুমে একেবারেই শুকিয়ে যাচ্ছে। ব্যহতহচ্ছে উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের খাদ্যশৃঙ্খল। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও ফসল উৎপাদনসহ পানি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সকল কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। বিপর্যয় ঘটছে সার্বিক পরিবেশের।
চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটি ও বড়াল নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব এসএম মিজানুর রহমান বলেন, নদ-নদী, খাল-বিল চলনবিলের প্রাণ। দখল দূষণের ফলে স্বকীয়তা হারাচ্ছে চলনবিল এলাকার নদ-নদী, খাল-বিলগুলো। এগুলো রক্ষা করতে না পারলে চলনবিল তার স্বকীয়তা হারাবেই। আমরা দীর্ঘদিন যাবত এ এলাকার নদ-নদী রক্ষায় আন্দোলন করে আসছি। দ্রুত নদ-নদী গুলো খনন করা হলে ঐতিহ্যবাহী চলনবিল প্রাণ ফিরে পাবে।
আনন্দবাজার/শহক