বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিস্ময়-শঙ্কাতেও আশ্বস্তি

ওমিক্রন

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে চলেছে নতুন ধরন ওমিক্রন। যা আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এ নিয়ে আলোচনা শেষ হওয়ার আগেই ওমিক্রনের নতুন তিনটি উপধরন বিস্ময়, শঙ্কা আর অস্বস্তির বার্তা দিচ্ছে দেশে দেশে। ইতোমধ্যে অন্তত ৪০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত বিস্তার ঘটে চলেছে এশিয়ায়। বিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্যমতে, ডেনমার্ক কিংবা সুইডেনের চেয়েও সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এখন ভারতে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও এই ধরনের উপস্থিতি বেশি দেখা যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ২৪ জানুয়ারি এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে ওমিক্রন। একই সঙ্গে ওমিক্রনের নতুন তিনটি উপধরনও (সাব-টাইপ) শনাক্ত হয়েছে। যা আফ্রিকান, ইউরো-আমেরিকান এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ধরনের সঙ্গে মিলে যায়। গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পর করোনামহামারির বিদ্যমান যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন ঢেউয়ের আতঙ্ক।

তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, নতুন এই ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে তারা গভীর পর্যবেক্ষণ করছেন। কারণ এই উপধরন নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তারা। যেসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসহ সম্মিলিতভাবে কাজ করতে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। অমিক্রনের সর্বশেষ ভার্সনে একশ জনের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে ব্রিটিশ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ। নতুন এই ভার্সন বা উপধরন (সাবভেরিয়েন্ট) মূলত বিএ.২। এ নিয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, অন্য যেকোনো ধরনের তুলনায় বিএ.২ ধরন দ্রুত বিস্তার ঘটাতে পারে।

তবে ওমিক্রনের বিএ.২ উপধরনের বিস্তারের অভিনব ক্ষমতা বিস্মিত করেছে ফ্রান্সের রোগতত্ত্ববিদ অ্যান্টোইন ফ্লাহল্টকে। তিনি বলছেন, এশিয়ায় এ ধরন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ডেনমার্কে বিস্তারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রয়েছে এই ধরনের। ফ্লাহল্ট মনে করেন, বিএ.২ উপধরন কীভাবে পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হচ্ছে, তা বিজ্ঞানীদেরই নির্ধারণ করতে হবে। তবে তিনি আশ্বস্ত করে বলছেন, নতুন এই উপধরনকে এখনো উদ্বেগজনক বলা হয়নি। সে কারণেই আক্রান্ত আর আক্রান্তের বাইরের দেশগুলোকে এ নিয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। বিজ্ঞানীরাও তাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে জরদারি জোরদার করেছেন।

আরও পড়ুনঃ  চট্টগ্রামে ফের জাল স্ট্যাম্প আমদানি

এদিকে, নতুন বছরের প্রথম দশদিনেই যুক্তরাজ্যে বিএ.২ উপধরনে আক্রান্ত হয় ৪০০ জনের বেশি রোগী। পাশাপাশি আরও ৪০ দেশে শনাক্ত হয় এই উপধরন। চলতি মাসের শুরু থেকেই দেখা গেছে, বিএ.২ উপধরনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ভারত, ডেনমার্ক, সুইডেনে। এমন পরিস্থিতিতে বিএ.২ উপধরন নিয়ে দ্রুত গবেষণা চালাচ্ছে যুক্তরাজ্যের হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সি (ইউকেএইচএসএ)। তারা এই উপধরনকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। গবেষকরা বলছেন, ওমিক্রনের জিন বিন্যাসের পরিবর্তন নিয়ে কিছু অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে।

ফ্রান্সেও বিএ.২ আক্রান্ত রোগী বেড়ে যাচ্ছে। সেজন্যই রোগতত্ত্ববিদ ফ্লাহল্ট বলছেন, নতুন উপধরনের নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য রয়েছে কি না তা নিয়েই আমাদের আগ্রহ বেশি। ইউকেএইচএসএ বলছে, বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে যে নতুন ভেরিয়েন্ট বা ধরন সেটা হলো বিএ.১। আর এটা আসলে ওমিক্রন। তবে ওমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় নতুন ধরন বিএ.২-কে পর্যবেক্ষণে রেখেছে সংস্থাটি।

তবে নতুন উপধরন নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিস্ময় আর ভয় থাকলেও খানিকটা আশ্বস্তির খবর দিচ্ছেন লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ টম পিকক। ভারত ও ডেনমার্ক থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি বলছেন, গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে বিএ.১-এর সঙ্গে বিএ.২-এর খুব বেশি পার্থক্য নেই। তাই বিএ.২ উপধরনের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কাজ করবে কিনা সেটা ভাবার প্রয়োজন নেই। তবে দুই উপধরনের মধ্যে সংক্রমনের ক্ষেত্রে কে বেশি ক্ষমতাধর সে বিষয়ে বেশি তথ্য নেই বিজ্ঞানীদের কাছে। তবে বিজ্ঞানীরা কিছুটা ইঙ্গিত পাচ্ছেন মাত্র। যা পর্যবেক্ষণ হিসেবে তুলে ধরতে পারেন।

ওমিক্রনের নতুন উপধরন নিয়ে দেশে দেশে সংক্রমনের যে উচ্চমাত্রা দেখা যাচ্ছে তাতে তৃতীয় ঢেউয়ের তোড় হিসেবেই দেখছেন অনেকে। আর সেই ভয় থেকেই বিভিন্ন দেশের সরকার নানা পদক্ষেপ যেমন নিচ্ছেন তেমনি আর্থিকখাতের ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাকারীদের মধ্যে প্রবল আতঙ্কও দেখা দিচ্ছে। টম পিককও অনেকটা অনিশ্চিতার ধকল কাটাতে বলছেন, ওমিক্রনের কারণে অনেক দেশই সংক্রমণের চূড়া স্পর্শ করেছে। আবার অনেক দেশে সংক্রমণ সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শের পথে। আমি বেশ অবাক হব, যদি এই বিএ.২-এর কারণে আরেকটি ঢেউ আসে। তবে এসব নিয়ে আশ্বস্তির বার্তা দিয়েছেন ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অলিভার ভেরান। তিনি বলছেন, অন্যান্য উপধরন যেভাবে প্রভাব ফেলেছে, ওমিক্রনের নতুন উপধরন বিএ.২ ঠিক তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না।

আরও পড়ুনঃ  শিক্ষার্থীর করোনার টিকাদান শুরু

অবশ্য টিকা নেওয়া থাকলে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ অপর ধরন ডেলটার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা জোরদার করতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মুখ্য বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন। তিনি বলছেন, যারা টিকা নেননি, তাদের ক্ষেত্রে এমনটা হবে না। এক টুইটে সৌম্য স্বামীনাথন বলেন, তাই করোনায় সংক্রমিত হওয়া টিকা নেওয়ার বিকল্প হতে পারে না, যেমনটা কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছেন!

প্রসঙ্গত, গেল বছর ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ৩০টি দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। নতুন ২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০০ দেশ ছাড়িয়ে যায়। তবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ওমিক্রন বিষয়ে ঠিকঠাক কোনো তথ্য পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা।

এক পর্যায়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুস আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, চলতি বছরের জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিটি দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে সব দেশকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। আর এটা করতে পারলে বর্তমান করোনা মহামারি অবসানের (শেষ) দিকে যেতে পারবে বিশ্ব। তবে তার বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করেন সংস্থাটির ইউরোপ অঞ্চলের পরিচালক হ্যানস ক্লুগ।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্স (আইসিএমআর)-এর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন এপিডেমিওলজিস্টের সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইসরি কমিটির চেয়ারম্যান ড. জয়প্রকাশ মুলীয়িল ১১ জানুয়ারি বলেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট প্রায় অপ্রতিরোধ্য। শেষপর্যন্ত সবাই এতে আক্রান্ত হবে। এমনকি কোভিড-১৯ টিকার বুস্টার ডোজও এর ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পারবে না।

আরও পড়ুনঃ  আবারও আসছে শৈত্যপ্রবাহ

যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের পূর্বাভাস উদ্ধৃত করে হ্যানস ক্লুগ বলেন, পূর্ণ ডোজ টিকা নেওয়া ব্যক্তিরাও ওমিক্রনে সংক্রমিত হতে পারেন। তবে ওমিক্রনে সংক্রমিত মানুষ গুরুতর অসুস্থ হন কম।

সে সময় ফাইজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলবার্ট বোরলা বলেন, ওমিক্রনের টিকা আগামী মার্চে প্রস্তুত হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার এ টিকা নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। টিকা তৈরির কাজ চলছে।
টিকার কার্যকারিতার বিষয়ে সিএনবিসিকে তিনি বলেন, করোনার বর্তমান টিকার যে দুই ডোজ এবং বুস্টার ডোজ ওমিক্রনে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে ভালো সুরক্ষা দিয়ে থাকে। একই বিষয়ে বায়োএনটেকের সিইও স্টিফানে ব্যানসেল বলেন, ওমিক্রনের বিষয়টি বিবেচনা করে তারা একটি বুস্টার ডোজ তৈরির কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি বলেন, ওমিক্রনের সংস্পর্শে আসতে পারেন সবাই। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে স্টিফেন মরিসন বলেন, ওমিক্রনের সংক্রমণক্ষমতা অস্বাভাবিক।

২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর চীনের উহান রাজ্যে করোনাভাইরাসটির উৎস হলেও খুব অল্প সময়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়ে ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যু হয়।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, ওমিক্রনের নতুন উপধরন বিএ.২ বাংলাদেশের চট্টগ্রামেও শনাক্ত হয়েছে। এটি এতোটা গুরুত্বপর্ণ নয়। কেননা বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এটিকে ততোটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারপরও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

আনন্দবাজার/শহক

Print Friendly, PDF & Email

সংবাদটি শেয়ার করুন