ঢাকা | বুধবার
১৫ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
১লা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সম্ভাবনার হোটেলখাতে শঙ্কা

সম্ভাবনার হোটেলখাতে শঙ্কা

বাংলাদেশের বড় বড় শহর নয়, জেলা ও উপজেলা এমনকি পাড়া মহল্লাতেও এখন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন হোটেল-রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠছে। তরুণদের একটি বড় অংশ নিজে নিজে উদ্যোগী হয়ে এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম পুঁজিতে স্বাধীনভাবে আয়ের সুযোগ থাকায় হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসা লাভজনক এবং জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেক ছাত্র-ছাত্রী বা তরুণ উদ্যাক্তা আছে যারা উচ্চশিক্ষিত হয়েও চাকরির পেছনে ছুটাছুটি না করে ব্যবসার দিকে লক্ষ্য স্থির করে রেখেছে। শুধু কর্মসংস্থান সৃষ্টি নয় দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে সেবাধর্মী খাতের অবদান ৫০ শতাংশের বেশি। যে একুশটি খাতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি তাদের মধ্যে এ খাতটি অন্যতম।

তরুণ প্রজন্মের জন্য রেস্টুরেন্ট মানেই একটি অন্যরকম আকর্ষণ। এখন তরুণরা যেমন রেস্টুরেন্টে যেতে ও খেতে পছন্দ করে ঠিক তেমনই একটি আকর্ষণীয় ব্যবসা হিসেবে তারা এটিকে বেছে নিচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয় বর্তমান বিশ্বে মোবালাইজড, আরবানাইজড, সামাজিক মিলনস্থল সব একাকার হয়ে যাচ্ছে। যেখানে মানুষ তার তাৎক্ষণিক বা প্রাত্যহিক প্রয়োজনে খাবার ও বিশ্রামের জন্য ছুটে যাচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে সার্বিক অতিথিসেবা আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে পরিবেশিত হয়ে থাকে। সেজন্যই হোটেল রেস্তোরাঁর কাস্টমারকে ‘অতিথি’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়ে থাকে।

বিশ্বের সবখানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপ আমেরিকায় এর ব্যবসায়িক চাহিদা প্রকট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা প্রাইভেট সেক্টরে দ্বিতীয় বৃহত্তম ও সামগ্রিকভাবে তৃতীয় বৃহত্তম ইন্ডাস্ট্রি। দ্য ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুসারে, ২০১৯ সালে দেশটিতে শুধু রেস্টুরেন্ট থেকেই ৮৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়। তাদের তথ্য মতে, রেস্টুরেন্টের চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৫.৩ মিলিয়ন যা ২০২৯ সালে এর সঙ্গে ১.৬ মিলিয়ন নতুন চাকরির যুক্ত হয়ে তার সংখ্যা ১৬.৯ মিলিয়নে গিয়ে পৌঁছাবে। দেশটিতে ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ছিল ২৩,৬৫০ এবং চাকরির সংখ্যা ছিল ৩১৭,৮০০।

আমাদের দেশে গত এক দশকে হোটেল রেস্টুরেন্টের সংখ্যা কত বেড়েছে ও জিডিপিতে এই খাত থেকে কী পরিমাণ মূল্য সংযোজন হচ্ছে তা জানার জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি জরিপ পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে মূল্য সংযোজন বেড়ে হয়েছে আট গুণ। এক দশক আগে ২০০৯-১০ অর্থবছরে হোটেল-রেস্টুরেন্ট থেকে মূল্য সংযোজন হয়েছিল মাত্র ১১ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাত থেকে মূল্য সংযোজন হয়েছে ৮৭ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় আট গুণ বেশি।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন হোটেল-রেস্টুরেন্টের সংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪। এক দশক আগে এই সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৪। এখন এই খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৩২ জনের। যার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১৮ লাখ ৩৭ হাজার। বাকিরা নারী। এক দশক আগে হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাতে কর্মসংস্থান ছিল ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৮৪ জনের। অর্থাৎ এখাতে কর্মসংস্থান বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

জরিপের তথ্য বলছে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে যারা নিয়োজিত আছেন, তাদের মজুরি বা বেতনের পেছনে সংশ্লিষ্ট এক অর্থবছরে খরচ হয়েছে ১৫ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। তাতে প্রতিবছর একজন শ্রমিকের মজুরির পেছনে খরচ হয়েছে গড়ে ৬৯ হাজার ৪৮ টাকা

গত বছরের ২৭ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত দৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশের ৬ হাজার ৭৩৪টি হোটেল-রেস্টুরেন্টের ওপর জরিপটি পরিচালনা করে বিবিএস। বিবিএসের ১৫১ জন গণনাকারী ও ৮০ জন সুপারভাইজার মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারি ও ২০১৯ সালের বিজনেস ডিরেক্টরি থেকে তথ্য নিয়ে জরিপটি করা হয়েছে। জরিপের প্রাথমিক ফলাফল সম্প্রতি সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

আমেরিকার সবচেয়ে পুরনো রেস্তোরাঁর নাম উইলিয়াম মায়েস। ১৬৭৩ সালে রড আইল্যান্ডে এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়। সেই একটি রেস্তোরাঁ থেকে একাধিক রেস্টুরেন্টের বিস্তারের মাধ্যমে আজ আমেরিকার বৃহৎশিল্পে রূপ নিয়েছে। দেশটিতে সবশ্রেণির রেস্টুরেন্টগুলো ধনি, গরিব, মধ্যবিত্তসহ ধনকুবেরদের তাদের বাণিজ্যিক আকর্ষণে প্রলুব্ধ করে।

বাংলাদেশেও এখন এখাতে অনেক পরিচিত ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে। ১৯৯৫ সালে এসে বাবা–ছেলে মিলে কারওয়ান বাজারে তৈরি করেন হোটেল সুপার স্টার। খাওয়ার সঙ্গে থাকার ব্যবস্থাও। এরপর একে একে ধানমন্ডি, সাতমসজিদ রোড, বনানী, এলিফ্যান্ট রোড, সবশেষে জনসন রোডে ডালপালা ছড়িয়েই চলছে স্টারের বেকারি, কাবাব ও রেস্টুরেন্ট। স্টার কাবাবের কর্ণধার আখতার উদ্দীন। শুরু থেকে হিসাব করলে স্টার বেকারি, কাবাব ও রেস্টুরেন্টের বয়স ৫০ বছরের বেশি।

শুধু দেশে নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিরা গড়ে তুলছেন নামি-দামি রেস্টুরেন্ট। আরব আমিরাতে হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বাংলাদেশিদের বড় একটি অংশ। অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় দেশটিতে তারা গড়ে তুলেছেন ছোট-বড় ২ সহস্রাধিক হোটেল-রেস্টুরেন্ট। তাদের গড়ে তোলা হোটেল-রেস্টুরেন্টের তৈরি খাবার ব্যাপকভাবে সুনাম বাড়াচ্ছে দেশটিতে।

করোনার ধাক্কায় সম্ভাবনাময় এ খাতটিতে এখন সংকটের ঘনঘটা। বিবিএস বলছে, করোনার প্রভাবে হোটেল-রেস্টুরেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এটা ঠিক। তবে এক দশকে এই খাত বেশ বিকশিত হয়েছে। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসেব মতে, দেশে তাদের তালিকাভুক্ত ৬০ হাজার রেস্তোরাঁর মধ্যে করোনার প্রথম ধাক্কায় ২৫-৩০ শতাংশ রেস্তোরাঁ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। দেউলিয়া হয়ে মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে প্রায় অর্ধেক রেস্তোরাঁর। তবে পরবর্তীতে ৬০-৭০ শতাংশ রেস্তোরাঁ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রণোদনা না পেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান নাজুক পরিস্থিতিতে আছে বলে দাবি করছেন রেস্তোরাঁ মালিকরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ও জেএন্ডজেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান হাসান আনন্দবাজারকে বলেন, দশ বছরে দেশ যেভাবে এগিয়েছে রেস্তোরাঁ ব্যবসাও সেভাবে এগিয়েছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে, বাইরে খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এখন নাজুক পরিস্থিতিতে আমরা এক টাকাও প্রণোদনা পাইনি, কোনো ব্যাংক সুবিধা পাইনি। ব্যাংকের দেনা দিতে পারছি না। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয়েছে। গত দু’বছরে করোনার জন্য আমারও ৮টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ১২টি মন্ত্রণালয়-প্রতিষ্ঠান আমাদের মনিটরিং করে। তবে আমাদের কোনো অভিভাবক নাই।

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সবখাতে প্রণোদনা দেয়ার সুপারিশ ছিল এফবিসিসিআইয়ের। সার্ভিস সেক্টরে প্রণোদনা নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি মূলধনের ওপর লোন দিচ্ছে। কেউ প্রজেক্ট লোন নিচ্ছে। তবে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মূলধনের বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দিতে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে বলেছিলাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন পরিবহন খাতে তা উঠিয়েও নেয়া হয়েছে। আমি মনে করি সরকারের উচিত হবে সেক্টর ধরে ধরে যেখানে সমস্যা আছে সেখানে কাজ করা।

ব্যাংকগুলো কেন ঋণ দিচ্ছে না- প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলামের কাছে। জবাবে দেশের সর্বোচ্চ ব্যাংকের এ কর্মকর্তা বলেন, প্রণোদনার স্কিমের মধ্যে পর্যটন খাতের সঙ্গে সেবাখাত হিসেবে হোটেল-রেস্তোঁরা খাত অন্তর্ভুক্ত আছে। তারা আগে কোথাও লোন নিয়ে থাকলে তা বৃদ্ধি করতে পারে। লোন আগে না নিয়ে থাকলেও নতুন লোন নিতে পারে। তারা যদি কোনো ব্যাংকে চেষ্টা করে লোন না পায় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী তা খতিয়ে দেখবে। আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নিব।

প্রণোদনা প্যাকেজে অন্তর্ভূক্ত থাকার পরও ব্যাংকগুলো লোন না দিয়ে কী বলছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ও ইমরান হাসান আনন্দবাজারকে বলেন, আমরা রেস্তোরাঁ খাতে ৪ ভাগ সুদে আলাদাভাবে ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দের কথা বলেছিলাম। এসএমই খাত থেকে কোনো ডকুমেন্ট ছাড়া আমাদের মালিকদের ১৫-২০ লাখ টাকা করে দিতে বলেছিলাম। অথচ আমাদের যেসব শর্ত দেয়া হয় এতে আমরা লোন পাব না। আমাদের আলাদা খাত হিসেবে কোনো লোন দেয় নাই। ফলে এটা হচ্ছে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি।\

অনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন