বিশ্বের সবচেয়ে বাজে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকার শীর্ষস্থানে থাকতেই যেন ঢাকার নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে শব্দ, পানি দূষণের ভয়াবহতা এখন নিত্যসঙ্গী। বিশ্বের সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন শহরের দিক দিয়েও সেরাদের তালিকায়। বায়ুদূষণে গেল কয়েক বছর ধরে রেকর্ডের পর রেকর্ড করে যাচ্ছে ঢাকা। তবে এমন প্রবণতা থেকে সহসা বের হয়ে আসার কোনো উপায় নেই। কারণ, সব ধরনের দূষণের পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করছে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগর সম্প্রসারণ কর্মকাণ্ড আর জনগণের জীবন ও কর্মকে সুসংহত করার জন্য ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ।
ঢাকার বায়ুদূষণের উৎস নিয়ে বিদায়ী বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক জরিপে বলা হয়েছে, রাজধানীর বাতাসকে এখন বিষিয়ে তুলছে যানবাহনের ধোঁয়া। বায়ুদূষণের অর্ধেকই (৫০ শতাংশ) মূলত তরল জ্বালানি পোড়ানোর কারণে তৈরি। ১০ শতাংশ ইটভাটায় কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া থেকে ও বাকিটা অন্যান্য ধোঁয়ার মাধ্যমে আসে। আন্তর্জাতিক সংস্থা-নামবিওর এক জরিপে দেখা গেছে, বেশি-যানজটের শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল নবম। যানজটের ফলেই বায়ুতে বেড়েছে দূষণের মাত্রা। মূলত দেশের অর্থনীতি বড় হওয়ায় বেড়েছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিধি। তাছাড়া দেশে নগরায়নের মাত্রাও বেড়েছে গত এক দশকে। এসব কারণে উন্নয়নের সঙ্গী হয়েছে দূষণ।
মূলত, দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বর্ধিষ্ণু মেট্রোপলিটন সিটি হিসেবে রাজধানী ঢাকা এখন অর্থনীতিতে বড় অবদান রেখে চলেছে। বিশ্বের সেরা নগরগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঢাকার যোগাযোগ, শিল্পায়নসহ সব ধরনের অবকাঠামো সুবিধা। মেট্রোরেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট রুট-বিআরটি, ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়েসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান। তবে এই উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ সহসাই শেষ হচ্ছে না। সে কারণে উন্নয়ন থেকে যে দুর্ভোগ বা দূষণের সৃষ্টি তা থেকেও মুক্তি মিলবে না।
সূত্রমতে, উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল ছাড়াও ঢাকায় আরো পাঁচটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এগুলো সম্পন্ন হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, সবকটি মেট্রোরেলের কাজ শেষ করতে আরো কয়েক বছর সময় লেগে যেতে পারে। ২০২৭ নাগাদ তৈরি হওয়ার কথা আরেকটি বিআরটি লেন। ঢাকা এবং ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ সম্পন্ন হতে লেগে যাবে আরো কয়েক বছর। পরিকল্পনাধীন তিনটি রিংরোড, ৮১ কিলোমিটারের বৃত্তাকার রেল, ২৫০ কিলোমিটারের বেশি সাবওয়ে নেটওয়ার্কের নির্মাণ শেষ হবে ২০৫০ সালে।
বলা যায়, আগামী ২০৫০ সাল পর্যন্ত চলমান উন্নয়নকাজের সঙ্গী করেই চলাচল করতে হবে ঢাকাবাসীকে। এই সময়ের মধ্যে মেগা প্রকল্প ছাড়াও কোনো না কোনো অজুহাতে প্রতিনিয়তই কাটা হবে ঢাকার সড়ক-মহাসড়ক ও অলিগলি। এর ফলে তীব্র থেকে তীব্রতর হবে দূষণ আর দুর্ভোগ। ফলে ক্ষতি হতে থাকবে শারীরিক ও আর্থিক। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অকালে ঝরে যাবে অসংখ্য প্রাণও।
বিদায়ী বছরে বসবাসযোগ্যতা নিয়ে যেসব জরিপ হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেই ঢাকার অবস্থান ছিল তলানিতে। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার অবস্থান ক্রমাগত নিচে নেমেছে। কয়েকটি ইন্ডিকেটরে দেখা যায়, ঢাকা কম বসবাস- যোগ্যতা ও বায়ুদূষণে দ্বিতীয়, জনসংখ্যা ও কম নিরাপত্তায় ষষ্ঠ, যানজটে নবম এবং উদ্ভাবনে বিশ্বের ৫০০ শহরের মধ্যে ৪৪৯তম।
ইন্টারন্যাশনাল ওয়েল বিল্ডিং ইনস্টিটিউট কি-স্টোনের (আইডব্লিউবিআই) ২০২১ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, দূষিত বাতাসের কারণে ঢাকায় ৭২০ জনের প্রাণহানি ও ৭৭৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অপরদিকে ঢাকা এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স (একিউআই) অ্যান্ড বাংলাদেশ এয়ার পলিউশন ওয়েব সাইটের তথ্যানুযায়ী, গত বছরে বায়ুদূষণে ঢাকায় আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর্থিক ব্যয় হয়েছে ৩২ কোটি মার্কিন ডলার যা টাকার হিসেবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।
বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজুয়ালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এক নম্বর হয়েছে। আর শহরের তালিকায় দিল্লির পরই রয়েছে ঢাকার নাম। সংস্থাটির হিসাবে ঢাকার বায়ু বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিনের চেয়েও বেশি সময়জুড়ে অনিরাপদ বা অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল। এটা ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিল ১২০ থেকে ১৩০ দিন। আর গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর রাত ৮টায় ঢাকা শহর বায়ুদূষণে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল।
আগের দিনের বায়ু দূষণের মানমাত্রা ২৬৯ নিয়ে ঢাকা বিশ্বে রেকর্ড করার পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবারও বায়ুদূষণে মানমাত্রা ২৪১ নিয়ে টানা দুদিন শীর্ষস্থানে উঠে আসে। এর অর্থ হলো ঢাকার বাতাসের মান ‘অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে রয়েছে। ঢাকা দীর্ঘদিন ধরেই বায়ু দূষণে ভুগছে। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকার বায়ু দূষণের ৩টি প্রধান উৎস হলো, ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো।
নগরবিদরা বলেছেন, উন্নত বিশ্বে একটি প্রকল্পের মেয়াদ যে সময় ধরা হয়, তার আগেই কাজ শেষ করা হয়। আর আমাদের দেশে সম্পূর্ণ উল্টো। প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর ধরলে তা শেষ করতে ৮ থেকে ১০ বছর লাগিয়ে দেয়া হয়। এতে জনগণের বিপুল অর্থের অপচয় হয়। তাদের ভোগান্তির সীমা-পরিসীমা থাকে না। এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৮.১৬ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। শুধু উৎপাদনশীলতা বা আর্থিক মানদণ্ডে এই ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ সম্ভব নয়। দেশ ও নগরবাসীর উপর ঢাকার যানজটের অর্থনৈতিক, সামাজিক-মনস্তাত্বিক ক্ষয়ক্ষতি আরো ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারি-এই বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক জার্নাল কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চে প্রকাশিত একটি গবেষণায়, বায়ুদূষণকে ‘মহামারি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে সারাবিশ্বে মানুষের গড় আয়ু প্রায় তিন বছর কমেছে। অকালে মারা যাচ্ছে প্রায় ৮৮ লাখ মানুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- তেল, গ্যাস, কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন দূষণ সৃষ্টিকারী কণার প্রভাব মানুষের ফুসফুসে প্রায় এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। গবেষণার প্রধান লেখক জস লেলিয়েভেল্ড বলেন, জনস্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব ধূমপানের চেয়েও ক্ষতিকর। মহামারির তুলনায় বায়ুদূষণেই বেশি মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। এর প্রভাবে ফুসফুসের অন্যান্য রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় এশিয়ায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। বায়ুদূষণের কারণে চীনে ৪ দশমিক ১, বাংলাদেশে ৪ দশমিক ৭, ভারতে ৩ দশমিক ৯ এবং পাকিস্তানে ৩ দশমিক ৮ বছর গড় আয়ু কমেছে। ধনী দেশগুলোর তুলনায় দরিদ্র দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপ এবং দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে বায়ুদূষণ তুলনামূলকভাবে কম। ধনী দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়ার রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং হাঙ্গেরিতে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ হয়।
ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রাকে হেজার্ডাস বা বিপজ্জনক বলেই অভিহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বায়ুমান যাচাইয়ের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়াল। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) গেল বছরের জানুয়ারিতে ঢাকার ধুলাদূষণ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। এতে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধূলিকণা জমে। সেই হিসাবে মাসে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধুলা জমার হিসাব পেয়েছেন তারা। ঢাকার চারটি পার্ক ও উদ্যানে বিভিন্ন প্রজাতির ৭৭টি গাছের পাতা সংগ্রহের পর এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
শব্দ দূষণ
ঢাকার এক তৃতীয়াংশ মানুষের শ্রবণশক্তি কমে যাবে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দাবি করা হচ্ছে। রাজধানীতে গণপরিবহন, প্রাইভেটকার, সিএনজি ও মোটরসাইকেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হর্ন বাজানো। মানুষের কাছে গাড়ির হর্ন অসহনীয় যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানবাহনের হর্ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনে উচ্চস্বরে মাইক ও সাউন্ড বক্স বাজানো হচ্ছে। শব্দ দূষণের ফলে সারাদেশের তুলনায় ঢাকায় বসবাসরত মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগসহ, ফুসফুসজনিত জটিলতা, মস্তিষ্কবিকৃতি, স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক চাপসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা।
পানি দূষণ
বুড়িগঙ্গার দূষণ যেমন পানিতে হচ্ছে, তেমনি তা আশেপাশেও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে মানুষের চামড়ার রোগ, ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ফুসফুস ড্যামেজসহ ফুসফুসের নানারকম রোগ হচ্ছে। বুড়িগঙ্গাকে দূষণ থেকে বাঁচানো প্রয়োজন। এজন্য আইন রয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, শুধু উপরের পানিতেই নয়, ভূগর্ভস্থ পানিও এখন দূষিত হচ্ছে। যা সুপেয় পানির নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলছে। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট নদী নিধনকে ‘যুথবন্ধ আত্মহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পরিবেশগত ছাড়পত্রবিহীন যে সব কারখানা ও স্থাপনা বুড়িগঙ্গার পাড়ে রয়েছে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছিলো হাইকোর্ট।
জানতে চাইলে ইকো-সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) এর চেয়ারম্যান রোকেয়া সুলতানা দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, পানি দূষণ ঢাকার অন্যতম একটি সমস্যা। এটি নিরসনের জন্য বেশকিছু উদ্যোগ দেয়া যেতে পারে। তারমধ্যে অন্যতম হলো ড্রনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। যত্রতত্র দিয়ে পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা ড্রেনে প্রবেশ করে। সেটি আবার নদীতে গিয়ে পড়ে। সে জন্য বুড়িগঙ্গার পানিকে দুষণমুক্ত করা প্রয়োজন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন সম্প্রতি দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেছিলেন, পরিবেশের সঙ্গে আমরা প্রত্যেকেই জড়িত। সবাইকে নিজ নিজ পক্ষ থেকে সচেতন হতে হবে। নিজের দায়িত্বটুকু যথাযথভাবে পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। নিজেদের ময়লা-আবর্জনা নিজেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
আনন্দবাজার/শহক